পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

উদ্যান রচনা করেন, সামঞ্জস্যবোধ তাদের সবচেয়ে সেরা অবলম্বন। সবুজ ঘাস ও গুল্মলতা অলঙ্করণ হিসেবে সুন্দর নিশ্চয়, কিন্তু তার বৃদ্ধিও মাত্রাতিরিক্ত নয়। মাত্রার বাইরে গেলে তা উদ্যানের পুষ্পসারকে আচ্ছন্ন করে, তখন তাকে বলি আগাছা। তেমনি উপভাষা-বাহিত লঘু সংস্কৃতির চেতনা আমাদের অপর পরিসরকে সৃষ্টির তাৎপর্যে মণ্ডিত করুক। একদেশদর্শী ভাবে আমরা যেন মূল ভাষাবিশ্বের প্রতিবন্ধক না হই।

 এমন যদি হয়, বীরভূমের সাহিত্য কিংবা চট্টগ্রামের সাহিত্য হয়তো বগুড়ার সাহিত্য কিংবা কাছাড়-সিলেটের সাহিত্যের সঙ্গে অসুস্থ ও অস্বাভাবিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হবে। প্রকাশ্যে অথবা প্রচ্ছন্নভাবে। বিশ্বায়নের দাপটে আমাদের আকাশ ঝাপসা, মাটি টলোমলো। এ সময় সামূহিক বাচন পুনরুদ্ধারের, পুনরাবিষ্কারের। সাংস্কৃতিক রাজনীতির মোড়লেরা নানা অজুহাতে ছদ্মসন্দর্ভের বিভ্রম তৈরি করে চলেছে। বিভ্রম থেকে উৎপাদিত হচ্ছে অলীক ব্যবধানের অবভাস। বাংলা ভাষার পতাকাতলে সমবেত হওয়ার এই তো মাহেন্দ্রক্ষণ। এ সময়ের বার্তা অন্তহীন দ্বিরালাপেরও। অতএব উপভাষার সঙ্গে ভাষার, একক বাচনের সঙ্গে সামূহিক বাচনের নতুন নতুন দ্বিরালাপের ক্ষেত্র আমরা যেন আবিষ্কার করতে থাকি। যে যেখানে আছি সেখানকার আলো-হাওয়া-রোদের চাহিদা অনুযায়ী। মূখ শয়তানের দল আমাদের সমবেত নবজাগরণে পরাভূত হবেই হবে। আমাদের আছে উনিশে মে, আমাদের আছে একুশে ফেব্রুয়ারি, আছে একুশে জুলাই, আছে সতেরোই আগস্ট।

 আমাদের গন্তব্যও এক। খণ্ডিত অস্তিত্ব থেকে পূর্ণ অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার দিকে আমাদের যাত্রা। উপভাষা আমাদের শৌর্য ও লাবণ্য, আমাদের লজ্জা ও দুর্বলতা নয়। শুধু চাই সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মাত্রাবোধ। ভুবনমোহনের কথা মনে রেখে বলব, ‘বঙ্গবাণীর অঙ্গচ্ছেদের শঙ্কা’ আমাদের আজও রয়ে গেছে। আমরা জানি, ‘শ্রীহট্টের কথ্যভাষা পুরাতন গৌড়ীয় বঙ্গভাষারই প্রতিকৃতি। আমরা তার শক্তি ও সৌন্দর্যের উৎস সাহিত্য ও সংস্কৃতির বহুস্বরিক বাচনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করব। অনধিকারীর পক্ষে তা সম্ভব নয়। ‘আমরা যে ভাষায় মাতৃস্তন্য পান করিয়াছি, তাহা অবিশুদ্ধ ভাবিতে পারি না। কিন্তু এই শুদ্ধতার। অর্জনের জন্যেও চাই যোগ্যতা।‘সাহিত্যদেহের রুধিরের অভাব দূর করার কথা ৯৩ বছর আগে ভুবনমোহন বলেছিলেন, এই সঙ্কট তো আজও রয়েছে। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? তখনও সত্য ছিল এই উচ্চারণ—‘ধনপুষ্ট পশ্চিমবঙ্গের উন্নত সাহিত্যের দিকে লক্ষ্য করিলে আমাদের গৃহদেবতা রক্ষা পাইবেন না।’ এখনও তা সত্য। আমাদের সীমায়িত অবস্থান কি শতাব্দী ধরে দৃষ্টিশক্তিকেও ক্ষীণ করে রেখেছে? ‘সাহিত্য শুধু ভাষার প্রাণ নহে, সমাজেরও প্রাণের অভিব্যক্তি’ ঠিক। তাহলে মাত্রাতিরিক্ত উপভাষা-চেতনাইকি আজও আমাদের গণ্ডিবদ্ধ করে রেখেছে? বড় আকাশ আমাদের হাতছানি দিয়েছে কিন্তু দাঁড় ছেড়ে বেশি দূর উড়তে পারিনি। ডানার ব্যবহার শিখিনি নাকি যথাপ্রাপ্ত পরিসরের অপরতা অদৃশ্য শেকল পরিয়ে দিয়েছে আমাদের?

৯৬