পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১০৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কী লিখি, কী লিখতে চাই

সময় যখন জহ্লাদ

গিলোটিন নির্মম উদাসীনতায় কাজ করে চলেছে। ধড় থেকে মুণ্ড আলাদা হয়ে পড়ছে, প্রকরণ থেকে অন্তর্বস্তু, বয়ান থেকে অন্বিষ্ট। কেউ বা ইচ্ছে মতো কুড়িয়ে নিচ্ছে মুণ্ড এবং যে-কোনও ধড়ে জুড়ে দিচেছ। তেমনি প্রকরণ এবং বয়ান যেন স্বয়ম্ভু; যে-কোনোভাবে তাদের প্রয়োগ করা চলে। দৈনন্দিন জীবনে মাটি ও আকাশের অনুপাত হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। আঁধি-প্লাবন-ভূমিকম্প-হিমানি সম্প্রপাত ব্যক্তিসত্তা ও সামাজিক সত্তার যথাপ্রাপ্ত আকরণগুলিকে ভেঙেচুরে তছনছ করে দিচ্ছে। পাশাপাশি স্থপতি স্বয়ং আত্মস্থাপত্য ধ্বংসের নেশায় উন্মাদ, বিভোর। এখন কেন্দ্র নেই কোননা, পরিধিও নেই। যে-কোনো বিন্দুতে আরম্ভ হতে পারে, শেষ হতে পারে যেখানে-সেখানে। হনন-উৎসবে মত্ত পৃথিবী। অস্তিত্ব আর জ্ঞান কৃষ্ণবিবরের গ্রাসে; সমস্তই আপাত এখন, সব কিছু গোলকধাঁধা।

প্রতিবাস্তবের কুহক

কখনও মনে হয় বার্গম্যানের চিত্রনাট্যের ভেতরে ঢুকে পড়েছি, কখনও বা লুই বুনুয়েলের চিহ্নায়িত দৃশ্যকল্প কল্লোলিত হতে দেখি। জীবন-জগৎ-বাস্তব সম্পর্কে ধারণা ক্রমাগত রূপান্তরিত হয়ে গেছে এতদিন। জটিলতা ও গ্রন্থিলতা তৈরি হয়েছে। নিয়মমাফিক। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ধারণার কাঠামোও চূর্ণবিচুর্ণ হয়ে যাচ্ছে অকল্পনীয় দ্রুততায়। জগৎ মুছে যাচ্ছে প্রতিজগতের সন্ত্রাসে, জীবন ডুবে যাচ্ছে প্রতিজীবনের চোরাবালিতে, প্রতিবাস্তবের তীব্র আবর্ত গিলে খাচ্ছে বাস্তবকে। সভ্যতা প্রমাণিত হচ্ছে খোলস বলে, বর্বরতাই তার শাঁস। তাই সন্ত্রাসকে এখন হার মানতে দেখছি। আরও বড়ো সন্ত্রাসের কাছে। বিশ্ব একনীড় হচ্ছে মানবিকতার উত্তাপে নয়, প্রতাপের চরম উদ্ধত আগ্রাসনে। এখন কে আর বলে ধানসিঁড়ি নদীর কথা, কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে। আমাদের লেখালেখি কি কুহকের কথকতা করবে এখন, যখন জীবনের পাঠকৃতি থেকে গলে-গলে পড়ছে পুঁজ-কফ-শ্লেষ্ম-পিত্ত মাখানো নিরাবেগ মেধা।

গভীর গভীরতর অসুখ এখন

আমরা বয়ে যাচ্ছি। দশকের পর দশক, শতকের পরে শতক ধরে। বয়ে যেতে-যেতে নিজেদের সময়ের সংরূপ নিজেরাই নির্মাণ করছি, পরিসরের সংজ্ঞা তৈরি করছি। সব

৯৯