পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কিছুর সম্মিলিত চাপ শুষে নিচ্ছে আমাদের লেখা। শুষে নিয়ে ফুরিয়ে যাচ্ছে না তার হয়ে ওঠা, সম্ভাব্য কোনও মাত্রাবোধের প্রতি ইশারাও করছে। কিন্তু তবু কিছু কিছু অন্ধবিন্দু অবারিত হয়ে পড়ছে। আমরাই আমাদর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে পড়ছি অহরহ। সুখের শরিক অসুখ, স্মৃতির শরিক বিস্মৃতি, গতির শরিক স্থিতি, মুক্তির শরিক রুদ্ধতা। কী ব্যক্তি-সত্তায়, কী সামূহিক সত্তায় কৃষ্ণবিবরের উপস্থিতি প্রকট হয়ে পড়ে তাই চূড়ান্ত উদ্ভাসনের মুহূর্তে। এই কূটাভাস আগেও ছিল; কিন্তু ইতিহাস-প্রত্যাখ্যানের আধুনিকোত্তর প্রবণতা সাম্প্রতিক কালে ওই কূটাভাসকে সমুৎপন্ন সর্বনাশের বার্তাবহ করে তুলেছে। বিমানবায়নের বিকট হিংস্র চেহারা বিশ শতকের শেষ দুটি দশকে উত্তরোত্তর নির্বাধ হতে দেখেছি। তবে ইদানীংকার নির্মানবায়ন প্রক্রিয়া ধূসরতম নেতির আকারগ্রাসী পরিণাম-গ্রাসী উপলব্ধিকে যেভাবে সক্রিয় করে তুলছে, তাতে সভ্যতা-সংস্কৃতি-লিখনবিশ্ব জুড়ে ব্যাপ্ত নিশ্চিহ্নায়নই সর্বেসর্বা। কী লিখব এখন, কেন লিখব, কার জন্যেই বা লিখব।

চিন্তা আর জিজ্ঞাসার অন্ধকার স্বাদ

লেখা ঘটে যায়, হয়ে যায়। তবু। সময়ের চক্রকে ক্লান্ত বিধুর বিপর্যস্ত হয়েও লেখা ‘ঘটনা’ হতে পারে। এখনও। কেননা, মালার্মে কবিতার ঘটনাস্থল হিসেবে যা উল্লেখ করেছিলেন, তা তো এখনও সত্য- “On the empty paper protected by its whiteness' (Sur le vide papier que sa blancheur defend)। লিখিত শব্দাবলী জন্ম নেয়, ঘটে যায়। শূন্য সাদা কাগজের সুরক্ষিত পরিসরে কালো-কালো আখরেরা ফুটে ওঠে, ভরিয়ে দেয় তৃপ্ত ও অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষার চিহ্নায়কে। মীমাংসা নয়, জিজ্ঞাসা জেগে থাকে। আরও আরও চিন্তাবীজ ছড়িয়ে দিয়ে। বাচনের আলো নয় কেবল, ছায়া আর অন্ধকার প্রসারিত হয় ক্রমশ। তবু কিছুই শেষ কথা হয় না, হতে পারে না। বহু অতৃপ্তিকে পেছনে রেখে সম্ভাব্য তৃপ্তির দিকে এগিয়ে যায় লেখা, এই মাত্র। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করি, এই অনুভবের ক্ষেত্রে আমাদের সঙ্গে তেরো শতকের ইতালীয় কবি গুইদো কাভালকান্তি যেন সহযাত্রী। তার একটি সনেটের প্রারম্ভিক দুটি পঙক্তি এরকম:

“We are the sad, dismayed pens,
the Scissors and the sorrowing knife"!

কলমের বিষণ্ণতা আর বিবিক্ততা তবে কি চিরকালীন? পর্বে-পর্বান্তরে পটভূমির বদল ঘটে শুধু!

লেখার সত্য, লেখার অবভাস

একুশ শতকে পা রাখার আগেই চারদিক থেকে ধেয়ে এসেছিল ভার্চুয়াল রিয়্যালিটির বার্তা। কী ধরনের বাস্তব বলব একে? প্রতীত নাকি ধারণাগত নাকি প্রতিভাসিত! যা-ই বলি, বহু শতক ধরে নিঃসপত্ন ও তর্কাতীত বাস্তব এখন অভূতপূর্ব প্রত্যাহ্বানের মুখোমুখি। কতভাবে এর প্রতিক্রিয়া দেখতে পাব, এ বিষয়ে জল্পনা না-করেও এইটুকু

১০০