পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সংক্রামক। ওই সাহিত্যকর্মের বিপরীতে যারা স্পন্দনময় জীবনের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, পণ্যায়নের সুবিধাবাদ প্রত্যাখ্যান করে নিজেকে ও পারিপার্শ্বিককে অনবরত খুঁজতে খুঁজতে লেখা’ আবিষ্কার করেছেন—এমন কি, বানপ্রস্থকালীন সত্তর পেরিয়েও তাদের, হ্যা তাদেরও, স্থলন হতে পারে। বর্ণবোধের দিনগুলি থেকে যে অজগরটি তেড়ে আসছিল—সেই অজগরের মায়াবী গ্রাসে শেষ পর্যন্ত তাদেরও পড়া অসম্ভব নয়। অপ্রাতিষ্ঠানিক চেতনা-নন্দন-বয়নের পক্ষে দাঁড়ানোর কথা বলা মানে আমৃত্যু লড়াইয়ের মধ্যে থাকা। এমন লড়াই, যাতে এক মুহূর্তের জন্যেও ঢাল এবং তরোয়াল হাত থেকে নামাননা চলে না। প্রশ্ন অবশ্য তবুও থেকে যায়। খড়ের পুতুল কত আর শক্ত মুঠোয় প্রহরণ ধরতে পারে? যাকে অবয়ব বলে ভাবছি, তা যদি পুরোদস্তুর মেকি হয়ে থাকে তাহলে তার ওপর কোনো দায়ই তো চাপানো যাবে না। যার অস্তিত্ব নিছক অবভাস, তাকে ঘিরে কোনো লেখার জগৎ পল্লবিত হবে কি? কিন্তু যাকে কখনো নিশানা ফলক ভেবেছি, যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণা ভেবেছি—তার সমস্ত বাচন আজ যদি আমাদের বিদ্রুপ করতে আসে, তাহলে?

 আসলে, গত দশ-বারো বছরে আত্মপরীক্ষা কঠোরতর হয়েছে, এইমাত্র। এ কেবল স্মরণীয়ের স্থলন হয়েছে বলে নয়, এইজন্যেও নয় যে আশ্রয়ের ধারণাটিও দুর্বল হয়ে পড়েছে। বরং পরীক্ষা দুরূহতর হয়েছে কেননা বিকল্প চেতনার প্রস্তাবকদের মধ্যে ব্যাপক আত্মবিদূষণের দুর্লক্ষণ দ্রুত প্রকট হয়ে পড়ছে। সহযাত্রী ও সহযোগী হওয়ার বদলে আমরা এখন অসুস্থ প্রতিযোগী ও অন্তর্ঘাতকের ভূমিকায় নেমে পড়েছি। অপ্রাতিষ্ঠানিক চর্যার আঁতুড়ঘরগুলিতে প্রাতিষ্ঠানিক অভ্যাসের বেনোজল ঢুকে পড়ছে। ফলে বন্যায় নালা-নদী-ডোবা একাকার হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। চারদিকে কেবল ‘আমাকে দেখুন আমাকে বুঝুন’ রব। দু-তিন বছর আগে যা ফিসফিস ছিল, এখন তা কোলাহল। খরিদ্দার নাই সকলেই বেচিতে চায়’ জাতীয় অবস্থা প্রায় এসে গেছে। এ সময়, এই পরিস্থিতিতে, কাঙ্ক্ষিত লেখা কি পক্ষাঘাতগ্রস্ত কলমে আসতে পারে? যাদের ওপর ভরসা ছিল, তারা ধাপে-ধাপে পণ্য-সাহিত্যের স্রোতে মিশে যাচ্ছেন। সূত্রধার-সত্তাকে গিলে খাচ্ছে সাহিত্যিকের নির্মাণ-প্রয়াস। ততক্ষণই লেখা যতক্ষণ নিয়মের খাঁচায় জীবন বন্দী নয়। কিন্তু যখন জীবনকে ময়নার মতো দাঁড়ে বসিয়ে ছোলা খাওয়াতে চাই, তার শেখানো বুলিতে আকাশের বার্তা ফুটবে না। এই মুহূর্তে অনিশ্চয়তার তাড়না লেখার প্রক্রিয়ায় ও পরিসরে অনুভব করছি কিনা, এই হল সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন। কেননা এই তাড়না সম্ভাবনাকেই কর্ষণ করে। গত দশকের দৃঢ় নিশ্চয়তা আজকের লিখিয়েদের মধ্যে অনুপস্থিত। যাঁরা দুই বা আড়াই দশক ধরে লিখছেন, তারাও আজ থমকে দাঁড়িয়েছেন যেন। কিছুটা কি বিভ্রান্ত নাকি চলতে চলতে হঠাৎই রসদ সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন তারা?

 আসলে, শুরুতে নান্দনিক ও সামাজিক ভাবাদর্শ সম্পর্কে ঝাপসা হলেও খানিকটা ধারণা ছিল তাদের। অতি দ্রুত বিকাশমান যান্ত্রিক বিশ্বের সর্বশেষ অভিঘাত তাদের গভীর সংবেদনাকে শুষে নিচ্ছে। হঠাৎই মায়াবী সব পর্দা সরে গেছে। নিজেদের

১০৫