পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

রুদ্ধ হয়ে পড়ে লিখনপ্রণালী। বিনোদনের সঙ্গে সামান্য আপস করতে চাইলেও লেখা পথভ্রষ্ট হতে বাধ্য। সন্দেহ নেই, এই মুহূর্তে দুরূহতম সংকটের মোকাবিলা করতে হচ্ছে লিখিয়েদের। সমস্ত প্রচলিত বিধিবিন্যাস ও আকরণ ভেঙে নিজের লিখনবিশ্ব নিজেরাই যদি তৈরি করতে না পারেন, তাহলে পাঠভ্রমে আত্মবিস্মৃত হওয়াই ভবিতব্য। অতএব প্রতিটি পরবর্তী মুহূর্তকে চিনে নিতে হচ্ছে পূর্ববর্তী মুহূর্তের সঙ্গে দ্বিরালাপে; বয়নে-অন্তর্বয়নে সময় ও পরিসরকে গেঁথে নিতে হচ্ছে নিরন্তর প্রশ্নের উত্থাপন করে। প্রতাপের কৃৎকৌশলকে প্রতিহত করার জন্যে যিনি নিয়ত প্রস্তুত নন—তাকে সাম্প্রতিক বারুদপ্রহরে লিখিয়ের পদবি দেওয়া যায় না।

 কিন্তু এতে কি জোরালো কূটাভাস তেরি হল না? ছোট-সেজো-মেজো-বড় প্রকাশনাসংস্থা থেকে ফিবছর গদ্যে-পদ্যে এত হরেকরকম বই বেরোচ্ছে যখন, সাহিত্যের হাটে তো পশরার বাড়বাড়ন্ত। বিচিত্র হরফে বিচিত্র বিষয় ঝলমল করছে; শহরে নগরে বইমেলায় ভিড়ও তো উপচে পড়ছে। বছর বছর পুরস্কার শিরোপা বিলি হচ্ছে। খেলার নিয়ম অনুযায়ী সাহিত্যের গ্রিনরুমে অঢেল ব্যস্ততা এখন, ফলে মূল মঞ্চে কুশীলবদের আনাগোনা যন্ত্রবৎ। সাহিত্য যেন বাজিকরের পুতুলখেলা। কেবল প্রতিযোগিতার রীতিমাফিক পোেষাক পাল্টানো আর শরীর মোচড়ানো চলছে। সংখ্যার বিচারে নির্ধারিত হচ্ছে উৎকর্ষ। বিজ্ঞাপনে-বিজ্ঞাপনে ক্রেতাদের বিভ্রান্ত করে বাজার ফুলে-ফেঁপে উঠছে। পাঠক হয়ে পড়ছেন বিমূর্তায়িত। একটি পাঠে ফুরিয়ে যাচ্ছে প্রয়োজন কেননা বিনোদনের ধর্মই এমন। তাৎক্ষণিক দাবি মেটানোর পরে তার দাম কানাকড়িও নয়। কিন্তু বাজার সচল রাখার জন্যে সর্বদা বর্তমান কালে থাকতে হয় পণ্যের যোগানদারদের। কেননা অতীত হওয়া মানে সর্বনাশ, দৃশ্যের অতীত মানে মনোেযোগের বাইরে চলে যাওয়া। ভোক্তাদের সঙ্গে চিরকাল অবিশ্বাস ও অনাস্থার সম্পর্ক যোগানদারের। দৃঢ় ভিত্তিতে সম্বন্ধ গড়ে ওঠে না বলে ডোক্তাও অনবরত বাহারে নতুন খোঁজে। যোগানে ঘাটতি হলে তার অভ্যাসে ছেদ পড়ে, তখন সে যায় অন্য চটকদার বিপণিতে। এমন পরিস্থিতিতে সাহিত্যিক হয়ে পড়েন দক্ষ ফেরিওয়ালা, নিজেকে সওদা করে বেড়ান তিনি এক হাট থেকে অন্য হাটে। স্বভাবত সেখানে টেক্সট নেই, নেই কনটেক্সট, নেই টেক্সচ্যুয়ালিটি। নেই পাঠ, নেই পাঠকসত্তা। এই যখন সাহিত্যের প্রাতিষ্ঠানিকতা, কেনাবেচার নিয়মতন্ত্রে বাঁধা রচনাকুশলতা-পরিশীলন মানে মিথ্যার বুদ্বুদপুঞ্জ। সুতরাং নিয়মের জাল ছিড়েই কেবল জেগে উঠতে পারে জীবন-ঘনিষ্ঠ লিখনপ্রণালী। এমন লেখা চাই আমাদের যা প্রতাপের কুটিকে মেনে নেয় না, পণ্যায়ন ও বিনোদনের মাদককে যা হেলায় প্রত্যাখ্যান করে।

 কোথায় পাব তারে, সেই মনের মতো লেখাকে, যা চালাকি দিয়ে ভোলাতে চাইবে! আধুনিক কিম্বা আধুনিকোত্তর প্যাচ-পয়জার দিয়ে যা জীবনবাসনায় অন্তর্ঘাত করবে। জ্ঞানপাপীদের ভিড় যখন প্রগলভ হয়ে ওঠে, বয়ান তখন জেনে-শুনে আত্মহননের

১০৯