পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

গোলকধাঁধায় হারিয়ে যায়। কীভাবে এই ক্ষতিকর প্রবণতার বিরুদ্ধে গভীর প্রতিরোধ জাগিয়ে রাখা সম্ভব, তা হাতে-কলমে দেখিয়ে গেছেন কবি জীবনানন্দ দাশ। আপাত-বন্ধুত্বের দাবিতে যাঁরা তাঁকে ‘মধুর অবসাদের ক্লান্তি’ বা ‘নির্জনতম কবি'র খাঁচায় বন্দী করতে চেয়েছিলেন তাদের হতচকিত ও বিক্ষুব্ধ করে জীবনানন্দ ওই খাঁচা ভেঙে ফেলেছেন। সাতটি তারার তিমির’ পর্যায় থেকে নিরন্তর আত্মবিনির্মাণ করে তিনি কবিতার প্রতিবেদনকে সমস্ত সাহিত্যিক চাতুর্য ও পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্ত থেকে মুক্তি দিয়েছেন। বাঙালি পাঠকের জন্যে এই জরুরি সংকেত তিনি পৌছে দিয়েছেন যে লেখা প্রতিটি মুহূর্তে সজীব ও নতুন কারণ তা অনায়াসে আত্মগত অভ্যাসের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু জীবনানন্দ-পরবর্তী কবিদের মধ্যে সূচনার বিনির্মাণ প্রবণতা ক্রমশ পুনরাবৃত্তির চোরাবালিতে তলিয়ে গেছে। কেননা বিশেষ প্রকরণ ব্যবহার করে পাঠকদের মধ্যে গৃহীত হওয়ার পরেই অবধারিত ভাবে কবিদের মধ্যে দেখা গেছে অভ্যাস-ভাঙার অনীহা। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায় বর্ণনার মতো বিশদ বেঁধানো সাতপাকে’ সেইসব কাব্যপ্রয়াস থেকে অগোচরে নির্বাসিত হয়েছে কবিতা। কৃত্তিবাস-পর্যায়ে তাই প্রতিশ্রুতির অভাব নেই; কিন্তু অভ্যাসের প্রাতিষ্ঠানিকতা শেষ পর্যন্ত সমস্ত কিছুকে পণ্যলোভন করে তুলেছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, তারাপদ রায়দের ব্যবসায়িক সাফল্যে তারতম্য থাকলেও তাদের লিখনপ্রণালীর জ্যামিতিক ছক অনুসরণ করতে গিয়ে আত্মঘাতী হয়েছে উত্তর-প্রজন্ম। উৎপলকুমার বসু, বিনয় মুজমদার, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, শঙ্খ ঘোষ এঁদের চেয়ে ভিন্নপথগামী যেহেতু সাহিত্যকর্ম ও জীবন্ত লেখার স্পন্দন সম্পর্কে তাদের প্রখর সচেতনতা রয়েছে। আবার কৃত্তিবাস ঘরানার ঠিক পরবর্তী পর্যায়ের কবিরা সুচিন্তিতভাবে কবিতার প্রাকরণিক ও অন্তর্বস্তুগত শৃঙ্খল ভাঙতে চাইলেন। কিন্তু শামসের আনোয়ার-ভাস্কর চক্রবর্তী-দেবারতি মিত্রদের কোনো নির্দিষ্ট ভাবকেন্দ্র ছিল। ফলে শেষ পর্যন্ত নেতির রিক্ততা তাদের লেখাকে গ্রাস করেছে। সত্তরের জলবিভাজন রেখা পেরিয়ে এসে কবিতার প্রতিবেদনে যাঁরা সময়ের সূক্ষ্ম ও তীব্র দ্যুতিময় অবয়ব ফুটিয়ে তুলতে চাইলেন, তাঁদেরও কারো কারো রৈখিক ভাঙার আয়োজন মাঝপথে শিথিল হয়ে গেল। পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, মৃদুল দাশগুপ্ত, রণজিৎ দাশ, অমিতাভ গুপ্তদের লিখনপ্রণালীতে মহানাগরিক দ্বিধা, সংশয়, আত্মদ্রোহ, প্রাকৃতায়ন অসামান্য বহুস্বরিকতার সম্ভাবনা জাগিয়েও তাই ক্রমশ স্তিমিত হয়ে পড়েছে।

 প্রশ্ন হল, কেন? যাঁদের নাম লিখেছি এবং যাদের নাম লেখা হয়নি—এঁদের দ্বারা জীবনানন্দের আত্মবিনির্মাণ কেন ঈপ্সিত মাত্রায় গৃহীত ও ব্যাখ্যাত হল না? জনপ্রিয়তার সহজ পথ এড়িয়ে, এমন কি, প্রতিকূল পাঠ-পরিবেশ সত্ত্বেও, যিনি দুর্মূল্য ভাবমূর্তির অধিকারী হয়েছিলেন—সেই কবি কত অক্লেশে ওই ভাবমূর্তি নিজেই ভেঙে দিলেন। এর মানে আত্মপ্রতিষ্ঠানে হাতুড়ির প্রথম আঘাতটি স্বয়ং কবিকে করতে হয়। সাহিত্যের জটাজাল ভেদ করে লেখার গঙ্গা কেবলমাত্র তখনই নেমে আসে তৃষ্ণার্ত জমিতে। এরই অন্য নাম হল নিরবচ্ছিন্ন বিনির্মাণ। এই প্রক্রিয়া যখন সচল থাকে, মনের উপনিবেশীকরণ

১১০