পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

এই উপলব্ধি জাগাতে পারে সুস্থ সংস্কৃতি-চেতনা। সুস্থ’ শব্দটি ব্যবহার করছি কারণ সংস্কৃতির নামে পঙ্গু, অবান্তর ও বকচ্ছপ ধ্যান-ধারণা ছড়িয়ে দেওয়ার ফলে অসুস্থতার বিকার মানবিক বিকাশের পক্ষে ভয়ঙ্কর বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ মানুষের আচার আচরণে, সংস্কার ও বিশ্বাসের প্রতিক্রিয়ায় ওই বিকার খুব দ্রুত শেকড় ছড়ায় আজও, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বোধ নিতান্ত বাইরের প্রচ্ছদ হয়ে থাকে। বিপদের এই একটা দিক। আবার, বিপদের অন্য আরেকটা দিক হল, সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যে চিন্তার স্বচ্ছতা কখনও কখনও হারিয়ে যায়, কূপমণ্ডুক অভ্যাসের সঙ্গে আপস করতে করতে লড়াইয়ের ইচ্ছাও বজায় থাকে না। শুরুতে লিখেছিলাম, সংস্কৃতি সময়ের সন্তান এবং সময়-প্রহরী। এখানে আরেকটি কথা বলা যাক, সময়েরও রয়েছে দুটো অবয়ব ও স্বভাব। আপাতকাল ও প্রকৃতকাল বলে এদের চিহ্নিত করতে পারি। সংস্কৃতি যেহেতু নীতি ও কৌশলের ওপর নির্ভরশীল, আপাতকাল থেকে অর্জিত প্রতীয়মান অভিজ্ঞতা ও প্রকৃতকাল সম্পৃক্ত উপলব্ধির দ্বিরালাপ সম্পর্কে সংস্কৃতিকর্মীর সচেতন থাকতেই হয়। প্রতীয়মানের প্রতি মনোযোগী হওয়াটা কৌশলের অঙ্গ, কিন্তু এইজন্যে বহুজনহিতায় বহুজনসুখায় উদ্যম সঞ্চালিত করার নীতি সম্পর্কে শিথিলতা দেখানো চলে না। কিন্তু আমাদের চারপাশে মাঝে মাঝে দৃষ্টান্ত দেখতে পাই, যা অতিসরলীকরণের সংক্ষেপিত পথে চটজলদি জনতা-সফল হতে চায়।

 সমসাময়িক সমস্যার মনোরঞ্জক সমাধানের আত্মপ্রতারণায় এবং গভীরে যাওয়ার ক্ষমতা ও উপলব্ধির অভাবে মোটা দাগের পথ ধরে চলতে চান কেউ কেউ। এদের সংস্কৃতি-চিন্তায় তাৎক্ষণিকের দাবি মেটানোর তাগিদ অত্যন্ত প্রবল বলে স্ফুলিঙ্গ-ধর্মী আয়োজন উড়ে গিয়েই ফুরিয়ে যায়। পথ তাই হারিয়ে যায় নিচ্ছিদ্রভাবে অন্ধকারে। গভীরে হাত রাখতে এরা অপারগ, মঞ্চসাজ তাই ভেঙে যায় বারবার। সংস্কৃতিকর্মীদের এখনও সমাজ আলাদা চোখে দেখতে চায়। মঞ্চের বাইরে ও ভেতরে মানুষটি একই রকম কিনা—তা বুঝতে চায়। গানে-নাচে-নাটকে যে-বিশ্বাস প্রতিফলিত হচ্ছে, সেই ভাবাদর্শের উপযোগী আচরণ সংস্কৃতিকর্মীদের জীবন-যাপনে পাওয়া যাচ্ছে কিনা, তা সমাজের সদা সতর্ক চোখ লক্ষ করে যাচ্ছে। তাই সাংস্কৃতিক চর্যা ও জীবনচর্যায় একই ভাবাদর্শের বিচ্ছুরণ না ঘটলে সংস্কৃতি হয়ে থাকবে নিছক প্রেক্ষাগৃহে পিঞ্জরায়িত। অতএব সব সংস্কৃতিকর্মী সময়-সেনানী নন; তাদের মধ্যেও রয়েছে আপাত ও প্রকৃতের বিভাজন। প্রকৃত সংস্কৃতিকর্মী তারাই, যাঁরা অজ্ঞাতসারেও রক্ষণশীল অচলায়তনের গ্রাসে পড়েন না এবং যে-কোনও মূল্যে অপ্রাতিষ্ঠানিক চেতনার পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরেন। তারা প্রতিবাদী ও প্রতিরোধমনস্ক। তারা জানেন, সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ হলেও তাতে রয়েছে নানা বৈচিত্র্য, নানা কৌনিকতা, নানা চড়াই-উৎরাই। তারা এও জানেন, ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন করে নিলেই সংকট; নিজেকে ‘বিরূপবিশ্বে নিয়ত একাকী’ ভেবে নিজের মুদ্রাদোযে নিজেরই শুধু আলাদা হয়ে যাওয়া।

 অথচ মানুষ নিজের শ্রমে সভ্যতার যে-ইমারত গড়ে তুলেছে, তা যৌথ জীবন-যাত্রা ও যৌথ উদ্যোগের ফসল। মানুষ যখন একাকী, মূলত তখনই সে বিভ্রান্ত। তাই শুভ

১২১