পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

নাস্তিকতার সমাজতত্ত্ব

 আস্তিক ও নাস্তিকের দ্বন্দ্র নানা পর্যায়ে নানা অনুষঙ্গে, আজও আমাদের সমাজে প্রাসঙ্গিক। ইতিহাস যদি সরলরেখায় এগোত, তাহলে হয়তো এই দ্বন্দুের ছায়া এতটা গাঢ় হত না। কিন্তু তা তো হয়ই না, বরং তৃতীয় সহস্রাব্দে পৌছেও আমাদের যে অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব নিয়ে সন্দর্ভ তৈরি করতে হচ্ছে—এর চেয়ে বিস্ময়ের, বলা ভালো, আক্ষেপের খুব কম কথাই আছে। আমরা আধুনিক থেকে আধুনিকোত্তর যুগে পৌছেছি। কি পৌছাইনি—এই নিয়ে কত না চুলচেরা তর্ক। অথচ প্রদীপের নিচেই বড়ো অন্ধকার। ঈশ্বর-ধর্ম-সংস্কার ইত্যাদি মানুষ নিজের প্রয়োজনে তৈরি করেছিল যখন সে-সময় সভ্যতার হাটি হাঁটি পা পা চলছে। তারপর নীল-গঙ্গা-আমাজান-মিসিসিপি দিয়ে কত জল বয়ে গেল, কত ভিসুভিয়াস আণ্ডন উগরে দিল, কত হিমালয় উঠে এল সমুদ্র থেকে—কিন্তু নিজের বোনা জালে বন্দী মানুষ বন্দিত্বের অভ্যাস ভেঙে দাঁড়াতে পারল না। শুরুতে লিখেছি, তৰ্ক নানা পর্যায়ে হয়, হয়ে থাকে। দেশ-বিদেশের সূক্ষ্মদর্শী দার্শনিকেরা যুগে-যুগে আস্তিক আর নাস্তিকের সংজ্ঞা নিয়ে প্রচুর বিতণ্ডা করেছেন। তাদের সূক্ষ্মতা ও গভীরতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে অন্য আরেক ধরনের বিতর্ক হয়েছে এবং আমজনতা নিজের মতো করে মীমাংসাও করে নিয়েছে। এই দুটি স্তরের মধ্যে সঙ্গতি অনেকক্ষেত্রেই হয় না এবং সঙ্গতি খুজে লাভও নেই। বরং দুই স্তরের ভাবনার মধ্যে শুধু কি সমান্তরাল অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটছে নাকি এই দুইয়ের মধ্যে সামাজিক মনের দ্বিবাচনিকতাও ধরা পড়ছে—তলিয়ে ভেবে দেখা দরকার।

 সাধারণভাবে আমরা আস্তিক বলি সেই মানুষকে যে ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, ধর্মে যার মতি আছে, পরলোক-পরজন্ম-কৰ্মফল মানে। এককথায় চিরাগত সংস্কারকে বিনা প্রতিবাদে যে মেনে নেয়, প্রশ্ন করে না কখনো। ছেলেবেলা থেকে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক আবহে শিষ্ট-দুষ্টের মধ্যে যে ভেদরেখা তৈরি হয়ে যায়, তার একদিকে রয়েছে আস্তিকেরা অন্যদিকে নাস্তিকেরা। তুলনামূলক ভাবে মহানাগরিক ও বৌদ্ধিক পরিবেশে এসব নিয়ে মাথা ঘামানো হয় কম; মাঝারি শহরে আর পিছিয়ে-থাকা। গ্রামগঞ্জে তোতাপাখির মতো এখনো এর আবৃত্তি চলে। এমন কী মহানাগরিক পরিশীলনে। বিদগ্ধ জনদের সামাজিক চিত্তেও রয়ে গেছে এই বিভাজনের ছায়া। যন্ত্রপ্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের পর্বে এতে বরং বিচিত্র জটিলতা তৈরি হয়েছে। যতটুকু অবশেষ রয়ে গেছে, তার প্রতি অভূত প্রশ্রয়ে পুষ্ট হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির বিষচক্র। উল্টোদিকে যারা নাস্তিক অর্থাৎ ঈশ্বরে যাদের বিশ্বাস নেই, ধর্মে যাদের মতি থাকার কথা নয়, পরলোক-পরজন্ম-কৰ্মফল নিয়ে (যাদের কিছুমাত্র মাথা-ব্যথা নেই—তাদের আত্মপ্রত্যয়

১২৭