পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

হাঁটুজলে দাপাদাপি করতে করতে একসময় ডুবজলে তো যেতেই হয়। এবং তখন, সাঁতার না জানলে একেবারে চলে না। বলা বাহুল্য, সাঁতারুকে সবচেয়ে আগে জল সম্পর্কে অবহিত হতে হয়। জলে চোরাস্রোত থাকে; তবু এসব মোকাবিলা না করে ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না। লিটল ম্যাগাজিন যাদের কাছে কেবল ক্ষণিক খেয়ালের উন্মাদনা, তারা এত কথা ভাবেন না কখনো। তাই অন্তহীন মিছিলের মধ্যে ঢুকে যাওয়া ছাড়া এদের অন্য কোনো ভূমিকাও গড়ে ওঠে না। কিছুদিনের মধ্যে যদি স্পষ্ট না হয় ছোট পত্রিকার তাৎপর্য কী, তার অস্তিত্ব কোন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার ফসল এবং এতে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলি কেন চিহ্নায়কের বিন্যাস হিসেবে গ্রাহ্য, তাহলে ধীরে ধীরে অনিবার্যভাবে পণ্ডশ্রমের চোরাবালিতে তলিয়ে যেতে হবে। এইজন্যে লিটল ম্যাগাজিন নিছক ইতিহাসের উপকরণ মাত্র নয়, আসলে তা হল ইতিহাসের নির্মাতা। বারবার আমাদের প্রচলিত অভ্যাসে হস্তক্ষেপ করে এবং অনেক ক্ষেত্রে বেপরোয়া অন্তর্ঘাত করে, সাহিত্যের খাত থেকে পলি সরিয়ে দিয়ে তা তীব্র ও দ্যুতিময় নবীন জলধারাকে গতিময় করে তোলে। একই কারণে ছোট পত্রিকাকে বিশেষভাবে আত্মবিনির্মাণপন্থী না হলে চলে না। কেননা কখনো কখনো নিজেরই সত্নরচিত পদ্ধতি, প্রকরণ ও অস্তবস্তু প্রাতিষ্ঠানিক স্বভাব অর্জন করে নেয়; তখন নির্মোহভাবে নিজেকে আঘাত করে জটাজাল থেকে প্রাণের গঙ্গাকে মুক্ত করতে হয়। নইলে আত্ম-অনুকরণের অভ্যাসে সমস্ত পদ্ধতি, প্রকরণ ও অন্তর্বস্তু থেকে হারিয়ে যেতে পারে ঈঙ্গিত নির্যাস। যেতে পারে না, হারিয়ে যায়। চিরতরে।

 অতএব লিটল ম্যাগাজিনের প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য হল অপ্রাতিষ্ঠানিকতা। প্রচলিত সাহিত্যের তেল-চিকচিকেনধরকান্তি দেখে যাঁরা প্রলুব্ধ হয়ে স্রোতের অনুকূলে হাত-পা ছুঁড়তে শুরু করেন, ওই স্রোতের ফেনা হয়ে ভেসে যাওয়া ছাড়া তাদের আর কিছুই করণীয় থাকে না। সাহিত্যের রূপ-রীতি-স্থাপত্য-অলংকরণ-ভাষা-বাচন-ভিত্তি-আকরণ: সমস্তই যেন রূপকথার মায়াপুরী হয়ে আমাদের যাবতীয় জিজ্ঞাসা-বিশ্লেষণকে নিদালির ঘুমে আচ্ছন্ন করে দেয়। তাই সাধারণ চোখে ধরা পড়েনা,এই মায়া আধিপত্যবাদী বর্গের তৈরি। প্রতাপের বিচ্ছুরণে সমস্ত মূল্যবোধ পরিকল্পিত ও নির্মিত বলে আমরা সেই ভাষা শুনি, সেই গ্রন্থনা দেখি যা কিনা ওই বর্গের অনুমোদিত। প্রতাপ যাদের গিলে খায়, সেইসব অস্তেবাসী জনের কণ্ঠস্বর সাহিত্য নামক ঐকতানে চির অনুপস্থিত। সাহিত্যের মূল্যবোধ আসলে সমাজের উঁচুতলার স্বার্থ-উপযোগী ও স্বার্থ-অনুমোদিত মূল্যবোধ। তাই ওই মূল্যবোধকে তীক্ষ্ণ জিজ্ঞাসার তীরে বিদ্ধ না করে, ওই মূল্যবোধের আশ্রয় হিসেবে গড়ে-ওঠা ভাষা-আকরণ-সন্দর্ভকে আক্রমণ না করে কোনো নতুন সম্ভাবনার জন্ম হতে পারে না। যদি তার মানে হয় সাহিত্যকর্ম বলে প্রসিদ্ধ বৌদ্ধিক বটবৃক্ষটির মূল উৎপাটন, তাহলে সম্ভাবনার নতুন জমিতে ফসল ফলানোর তাগিদে তা-ই করতে হবে। বস্তুত করাও হচ্ছে। বাঙালির ভুবন জুড়ে প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের প্রতিসন্দর্ভকে মশালের মতো জ্বালিয়ে রাখছেন যাঁরা, তাদের মধ্যে আমরা দেখছি অপ্রাতিষ্ঠানিক নবীন চেতনার উৎসব। এই উৎসবে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে আধিপত্যবাদী

১৪০