পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বাহিনী। এদের খপ্পর থেকে সে-ই বাঁচাতে পারে যে জানে এরা কেন কী করছে। স্বাধীনতাকে যারা বিনিময়যোগ্য মনে করে, যে-কোনো অজুহাতে এরা সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। লিটল ম্যাগাজিনের লড়াই মূলত এই সংক্রামক প্রবণতার বিরুদ্ধে। চারদিকে ভাগাড় আর জঙ্গলের স্তুপ দেখে নিপাট ভালোমানুষ ভদ্রলোকের মতো নাকে রুমাল চাপা দিয়ে ফুলবাগানের সন্ধান করেন। যিনি, ছোট পত্রিকার যুদ্ধ অন্তত তার জন্যে নয়। নগদ-বিদায়ের অবিরাম হাতছানি উপেক্ষা করা ওই যুদ্ধের প্রথম ধাপ। যোদ্ধাকে জানতে ও ভাবতে হয়, কেন ভাগাড়ের চারদিকে ঘিরে এত শকুন আর ফেউদের আনাগোনা ও হল্লাবোল। আধিপত্যবাদীরা কীভাবে এই পৃথিবীকে মানুষের পক্ষে অব্যবহার্য করে তুলছে ক্রমশ, এটা দেখানো এবং বোঝানো তার যুদ্ধ। যতক্ষণ এই উপলব্ধিতে না পৌছাচ্ছেন, অন্তত ততক্ষণ লিটল ম্যাগাজিনের মাইন-বিছানো রণভূমিতে তিনি ফুরফুরে ফুলবাবুমাত্র হয়ে থাকবেন। বলা বাহুল্য, যুদ্ধক্ষেত্র আর যা-ই হোক, সৌখিন হাওয়া বদলের জায়গা নয়। তাতে বিস্ফোরণের কালো ধোঁয়ায় দম আটকানোর সম্ভাবনা অন্তত উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এর চেয়ে বরং প্রাক্তন বিপ্লবীদের মতো কিংবা সাহিত্য করে’ নামী দামী হওয়া আধিপত্যবাদের খয়ের খাঁ-দের মতো সহজ ও স্বাভাবিক পথে বিচরণ করা অনেক বেশি নিরাপদ। এতে ‘স্বাধীন’ও থাকা যায়, চিন্তা তাতে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হোক বা খাঁচাবন্দী হোক। আধিপত্যবাদ অপরিসীম দক্ষতায় দৃশ্য ও অদৃশ্য পিঞ্জর তৈরি করে চলেছে প্রতিনিয়ত। এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মানে সামগ্রিক প্রতিরোধ ও বিকল্প প্রতিবেদনের সন্ধান। এই কাজ লিটল ম্যাগাজিন করে যাচ্ছে বলে পীড়ন প্রায় সর্বগ্রাসী হয়েও বাংলা সাহিত্যের একমাত্র সত্য হতে পারেনি।

 সমাজে ও সাহিত্যে ছোট-বড়ো অজস্র প্রতিষ্ঠান দিন-দিন কেন তিমিলি হয়ে উঠছে, এর উত্তর খুঁজতে হবে আমাদের জীবনের নানা অনুপুখে। এই বাড়বাড়ন্ত কি শেষ সত্য? জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী-কমলকুমার মজুমদার-অমিয়ভূষণ মজুমদারের মতো লিখিয়েরা যে আপসহীন প্রতিবাদ ও বিকল্প সাহিত্যের প্রতিস্রোত গড়ে তুলেছেন, তা বাংলা সাহিত্যের বিস্তৃত ভুবন জুড়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক চেতনার অক্ষয় প্রেরণা হিসেবে আজও সক্রিয়। পাশাপাশি যদিও পণ্যসাহিত্যের রমরমা অব্যাহত রয়েছে, তবু লিটল ম্যাগাজিন থেমে থাকেনি। কেননা থেমে থাকাও তো এক ধরনের পরাজয়েরই স্বীকারোক্তি। তাই যাবতীয় স্থিরতা, পরিবর্তন-অনীহা ও মানিয়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এইসব লেখকেরা সুযোগসন্ধানী মধ্যবিত্ত বর্গের সাহিত্যিক মুখোশকেই খুলে দিয়েছেন। ভাষা ও চেতনার কাঠামোয় অন্তর্ঘাত করে তারা আসলে প্লিসর্বস্ব ঘুনধরা বাণিজ্যিক সমাজের বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়িয়েছেন। ছোট পত্রিকার শমীবৃক্ষ থেকে আগুনের মতোই ধারাবাহিকভাবে জ্বলে উঠেছেন শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, অসীম রায়, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবিমল মিশ্র, সুবিমল বসাক, শৈলেশ্বর ঘোষ, উদয়ন ঘোষ এবং এরকম আরো কয়েকজন লিখিয়ে। তারা সাহিত্যের নামে প্রচলিত আত্মপ্রতারণাকে আক্রমণ করেছেন বিনা দ্বিধায় এবং কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে দ্বিধা

১৪৩