পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 সমস্যার মূল কারণ, নতুন কিছু পড়তে অনীহা আর নতুনভাবে চিন্তা করতে আপত্তি। যখন প্রচলিত বিদ্যাচর্চা ও চিন্তাপ্রস্থানের সীমানা মুছে যাচ্ছে, সাহিত্যিক প্রতিবেদন কি নতুন কালের বার্তাকে ‘ওকে ছুঁয়োনা ছুঁয়োনা ছিঃ ও যে চণ্ডালিনীর ঝি, নষ্ট হবে যে দই সেকথা জানো না কি বলে ছোঁয়া-বাঁচাননা দূরত্বে চলে যেতে পারবে? দর্শন-ইতিহাস-সমাজতত্ত্ব-রাজনীতি-অর্থনীতি-বিজ্ঞানের সংশ্লেষণে যে অনেকান্তিক সন্দর্ভ তৈরি হয়ে চলেছে, তার বহুস্বরিক তাৎপর্য উপলব্ধির জন্যে সাহিত্যকেও নানা ধরনের তাত্ত্বিক আয়ুধে সজ্জিত হতে হচ্ছে। যে এই অনিবার্য সত্যকে অস্বীকার করছে, সে আত্মঘাতী হচ্ছে মাত্র। ভাষা দুরূহ নয়, দুরূহ হচ্ছে এই সময়; দুরূহ নয়, দুর্বোধ্য। কিন্তু মানুষ তো অপরাজেয় সৈনিক; সে এই দুর্বোধ্যতায় ত্রস্ত হবে কেন? বরং গোলকধাঁধায় প্রবেশ ও নিষ্ক্রমণের জন্যে নতুন নতুন দিশা খুঁজে নেবে। এই দিশা খোঁজার অভিব্যক্তি হল তত্ত্ব। সাহিত্য যেহেতু স্বভাবত জীবন-ঘনিষ্ঠ, তার প্রতিটি বয়ানে থাকবে তাত্ত্বিকতার মোহর। কখনো তা স্পষ্ট আর কখনো আভাসিত, এই মাত্র তফাত। যাকে সাহিত্য বলছি তা আসলে দর্শন। এই দর্শনে ব্যক্তি উপলক্ষ মাত্র, সমাজই প্রকৃত অন্বিষ্ট। অতএব এমন বাচন ব্যবহৃত হবে সাহিত্যে যা শুধু বর্ণনা দিয়ে ফুরিয়ে যাবে না, ইঙ্গিতে ফুটিয়ে তুলবে পরাবাচনের আভা। একক বাচনের সঙ্গে সামূহিক বাচনের দ্বিরালাপ হবে ওই বয়ানের প্রধান আধেয়। এ কোনো তত্ত্বকথা নয়, এ হল চলমান জীবন থেকে পাওয়া অনুভূতির নির্যাস।

 এইজন্যে সাহিত্যিক প্রতিবেদনে অভিব্যক্ত তত্ত্বজিজ্ঞাসায় পরিভাষার গ্রন্থনা অনিবার্য। পরিভাষা মানে তো কঠিন করে বলা কথা নয়; চিন্তার যে-বীজতলিকে অন্য কোনোভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয়, পরিভাষা হল তার একমাত্র আশ্রয়। পরিভাষা থেকে অর্থের বহুধা বিচ্ছুরণ লক্ষ করে শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই; একে বরং তার ঐশ্বর্যের দ্যুতি হিসেবে বন্দনা করাই কাম্য। পরিভাষার গ্রন্থনা যাঁদের কাছে দুরূহ, তারা অনুগ্রহ করে অধ্যবসায়ী হোন। বাংলা ভাষার একটু দূরবতী উৎসধারায় তারা অবগাহন করুন। প্রাথমিক দ্বিধা কেটে গেলেই বুঝবেন, কী অসামান্য সম্ভাবনার বীজতলি তাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। কিছুদিন আগে অন্য একটি প্রসঙ্গে যা লিখেছিলাম একটি প্রত্যয়ের ঘোষণা হিসেবে, আরো একবার তা ফিরিয়ে আনছি: কোনো সূক্ষ্ম ও গভীর ভাব-বিচ্ছুরণ প্রচলিত ভাষায় কুলোয় না। তাই ভাষার ভিত্তি খুঁড়তে হয়। প্রসারিত করতে হয় অন্তর্বর্ত ক্রিয়াপদের সম্ভাবনা। এমন কি উপসর্গের বা প্রত্যয়ের একক ও যুক্ত তাৎপর্য পুনর্নির্মাণ করতে হয়। কখনো কখনো ফিরে যেতে হয় প্রাতিপাদিকের আদি পরিসরে। সব কিছুই আছে ভাষার গভীরে; তাকে কেবল পুনর্গঠন ও পুনরাবিষ্কার করে নেন পরিভাষা-ভাবুকেরা। পৃথিবীতে দ্রুত তত্ত্বচিন্তার পরিধি বেড়ে যাচ্ছে। খুলে যাচ্ছে শাখাপথের দিগন্ত। শুধুমাত্র ভাষাতত্ত্ব আর সাহিত্যতত্ত্বে দেখতে পাচ্ছি কত বিচিত্র আয়তন। ইউরোপীয় ভাষাবিশ্ব আজ বাঙালির নিজস্ব ভুবনেও নতুন নতুন প্রবণতার বীজাধান করছে। চিন্তার বিশ্বায়নের যুগে পুনর্নির্ধারিত হচ্ছে সমাজ-সংস্কৃতি-ইতিহাস বিষয়ক সীমান্তের ধারণাও। অপরিচিত ভাববীজ

১৬৩