পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ভাষার পুরোনো আকরণে গৃহীত হতে পারে না। তার জন্যে চাই পুরোপুরি নতুন উদ্যম, নতুন সংহিতা, নতুন কৃৎকৌশল। পরিভাষা এইজন্যে আবশ্যিক এখন। অপরিচয়ের দূরত্ব প্রথম পাঠে কিছুটা বাধা তৈরি করবেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আপত্তি বিরোধিতা পর্যন্ত গড়াবে। ভাবের দুরূহতাকে ভাষার দুরূহতা বলে মনে করেন কেউ কেউ। বারবার পড়া ছাড়া এই ভ্রম কাটিয়ে ওঠার অন্য পথ নেই কোনো। পরিভাষা যখন সার্থক তাতে লক্ষ করি বহুস্বরিকতা। একে যদি বুঝে নিই সতর্কভাবে, দুরূহতা সংক্রান্ত আপত্তি খুব বেশি দিন টিকবে না। গত কয়েক বছরে বাঙালি তত্ত্বচিন্তায় নিবিষ্ট থেকে নিবিষ্টতর হচ্ছে। এসময় তাই ভাষাচেতনার নয় শুধু, পরিভাষাচেতনারও।

 এরপর সম্ভবত খুব বেশি কথা বাকি থাকে না। এইটুকু শুধু বলা যে, পরিভাষা কোনো সত্যিকারের অধ্যবসায়ী পড়ুয়ার পক্ষে প্রতিবন্ধক হতে পারে না। অভ্যাসের অবিরল প্রবাহে তা ছেদ তৈরি করে বলে যাঁরা হোঁচট খাচ্ছেন, তাদের শুধু সময়ের অভিজ্ঞান ও দাবি বুঝে নিতে হবে। জীবনযাপনে সব কিছু যখন বদলে যাচ্ছে, সাহিত্য-পাঠ আর বিশ্লেষণ-পদ্ধতিও বদলাতে বাধ্য। তত্ত্ব তো ওই রূপান্তরকে চেনার জন্যে, প্রবহমানতা ও পরিবর্তনের দ্বিরালাপকে বোঝার জন্যে। তত্ত্বকে যষ্ঠির মতো নয়, প্রদীপের মতো ব্যবহার করাই বিধি। সেই প্রয়োগ করাও হচ্ছে। প্রদীপে যষ্ঠিভ্রম তো রঞ্জুতে সর্পভ্রমের চেয়েও মারাত্মক। তত্ত্ব সূর্যের মতো নিরপেক্ষ, পর্বতে ও সমভূমিতে তার আলো ও উত্তাপ সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে কুয়াশা ও অন্ধকার, সেখানে তত্ত্ব আলো দেয় দৃষ্টিকে লক্ষ্যাভিমুখী করার জন্যে। আর, যেখানে আলোর আভাস থাকলেও তা অপরিস্ফুট, সেখানে তত্ত্বের কাজ উজ্জ্বলতা ও তীক্ষ্ণতা বাড়িয়ে দেওয়া। অন্ধকার ঘরেও একটি কোনে প্রদীপ জ্বালালে তা যেমন পুরো ঘরকে আলোকিত করে, তেমনি সাহিত্যতত্ত্বও সম্পূর্ণ প্রতিবেদন বা পাঠকৃতিকে উদ্ভাসিত করে তোলে। অনেক প্রচ্ছন্ন তাৎপর্য তখন দৃষ্টিগোচর হয়, সামান্যের অন্তরালে আবিষ্কৃত হয় বিশেষের অস্তিত্ব।

 নিজেদের বিশ্বাসে, অভিজ্ঞতায়, অনুভূতিতে তত্ত্বের উপস্থিতি যখন হৃৎস্পন্দনের মতো স্বাভাবিক হয়ে যায়—তখন সাহিত্যপাঠ কেবল শ্রম ও অধ্যবসায়ের বিষয় থাকে। তা হয়ে ওঠে কুঁড়ি থেকে ফুলের জেগে ওঠা দেখার মতো আনন্দদায়ী প্রকরণ। আরো নিবিড় ভাবে চিনি নিজেকে, জগৎকে, সম্পর্কের রুদ্ধ ও মুক্ত বিন্যাসকে; সাহিত্য-পাঠ ও জীবন-পাঠের যুগলবন্দিকে তখন আর কষ্ট করে বুঝতে হয় না। সাহিত্যতত্ত্বের তত্ত্ব অর্থাৎ পুরাতত্ত্ব নিয়ে কোনো বাকৃবিস্তার না করেও বলা যায়, প্রকৃত জীবন আর কল্পিত জীবনের মধ্যে প্রলম্বিত সব অদৃশ্য পর্দা সরিয়ে দেওয়া সাহিত্যতত্ত্বের অন্যতম লক্ষ্য। প্রকৃত জীবন যতক্ষণ স্পষ্ট না হচ্ছে, অন্তত ততক্ষণ বিশ্লেষণী সমালোচনা পথ ও পাথেয় খুঁজে পাবে না।

 সমালোচক তত্ত্বের দর্পণে নিজেকে দেখেন আবার সমান্তরাল ভাবে সাহিত্যকেও দেখেন। তত্ত্ব ও জীবনের মধ্যে দ্বিমেরুবিষমতা ভ্রান্ত ধারণা। বস্তুত সামাজিক জীবনই তো কোনো-না-কোনো ভাবে তাত্ত্বিকতার আধার। তেমনি তত্ত্বও বাস্তব সামাজিক

১৬৪