পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

জব চার্নকের ঐতিহ্যপুষ্ট কলকাতা, সবার কাছেই উত্তর-পূর্বাঞ্চল যদি সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক ট্যুরিজমের চিড়িয়াখানা বলে গণ্য হয়, তাহলে অন্তর্জাল—বিশ্বায়ন—উপগ্রহ প্রযুক্তি—ধর্মীয় মৌলবাদ—আঞ্চলিক ভাষা-উপনিবেশবাদ ইত্যাদির বিচিত্র ককটেলে ভয়ঙ্কর মাদকই শুধু তৈরি হবে ক্রমাগত। সুতরাং বাংলা ভাষা-ভাষী সহ অন্য সমস্ত ভাষা-ভাবুকদের মধ্যে নিজস্ব বিনিময়ের ক্ষেত্র তৈরি হোক। কেন্দ্র ও পরিধির সুনির্দিষ্ট স্বর্গের সেই পুরনো চিন্তাপ্রণালী ক্লিশে এবং সেইজন্যে বর্জনীয় বলে ঘোষিত হোক। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আলো হাওয়া রোদে যারা পুষ্ট, তাদের কাছে নদী ও অরণ্য, উপত্যকা ও পর্বত লালিত নৈসর্গিক চিহ্নায়কগুলি সত্য হয়ে আসুক। মহানাগরিক বৈদগ্ধ্য, অন্তঃসারশূন্য সপ্রতিভ ভঙ্গি, মেকি আন্তর্জাতিকতার মোহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের স্বভাবত বহুত্ববাদী জীবনে কোথাও প্রাসঙ্গিক নয়। চিড়িয়াখানার জীবদের প্রতি ট্যুরিস্টসুলভ দৃষ্টিপাত তাই প্রত্যাখ্যাত হোক।

 কিন্তু এতসব বলার পরেও আরও অনেক কথা থেকে যায়। একদিকে সংস্কৃতি সমবায়ের অনেকান্তিকতা এবং অন্যদিকে স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞানের প্রতি আনুগত্য: এই বৈপরীত্যের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটবে কীভাবে? সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞানের সামর্থ্যে যাদের একান্ত নির্ভরতা, তাদের কাছে অস্তিত্বতাত্ত্বিক বা জ্ঞানতাত্ত্বিক মুক্তি আসবে কোন পথে? তাছাড়া উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নানা কারণে এত জটিল হয়ে পড়েছে যে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ জনগোষ্ঠীগুলি একে অপরের প্রতি বিরুদ্ধ ও বিদ্বিষ্ট। প্রত্যেকেই চাইছে বিশ্বায়নের মাদকতাময় ভোজসভায় যোগ দিতে আবার সঙ্গে সঙ্গে আপন বন্দিশালাকে অটুটও রাখতে চাইছে। শানিত যুক্তির সংঘর্ষ নয়, পূর্বনির্ধারিত সংজ্ঞা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছোটো ছোটো সংঘের যুক্তিহীন ও পারম্পর্যহীন সংঘাত অপরতার দ্বিবাচনিক তাৎপর্যকে কখনও স্পষ্ট হতে দিচ্ছে না। তার ওপর রয়েছে। প্রত্ন-আধুনিক ও আধা-আধুনিক অভ্যাস-পরম্পরার সঙ্গে নব-ঔপনিবেশিক চিন্তা-প্রণালীর সংকর সমাবেশ। এরই মধ্যে চলেছে নিঃশব্দ বিনির্মাণের পালা। বাংলা ভাষার নান্দনিক ও সাহিত্যিক সংরূপ কর্ষিত হচ্ছে আঞ্চলিক অভিজ্ঞতা ও মননমুদ্রাকে আত্মস্থ করেই। মহাসাগরের মধ্যে ইতস্তত ভাসমান কিছু ভেলার মতো সাহিত্যিক অভিব্যক্তিগুলি জেগে ওঠে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। কখনও কখনও এইসব দ্বীপের মধ্যে সেতু রচিত হয় যদিও, সরকারি বা বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অনুপস্থিতিতে এইসব সেতুর সামাজিক তাৎপর্য সর্বদা স্পষ্ট হয় না।

 ‘Garden of Ethnic variety’ বলে পরিচিত এই অঞ্চল অনস্বীকার্যভাবে অনেকান্তিক অথচ এর স্বাভাবিক পরিণতি বহুবাচনিকতা নয়। এখানে ছিন্নবিচ্ছিন্ন ভাবে আধুনিক জীবনবোধের কিছু কিছু লক্ষণ দেখা গেছে কিন্তু তা আধুনিকতাবাদী প্রবণতা তৈরি করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। কেউ কেউ দূরবর্তী মহানগরের ছত্রছায়ায় একলব্যের মতো স্বয়ংলালিত হয়ে অবক্ষয়বাদ কিংবা আধুনিকোত্তর মুদ্রার আশ্রয় নিয়েছেন বটে,

১৮৪