পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

দেখার ক্ষমতা। মানুষ যে আজও কত বিস্ময়ের দীপাধার, নৃত্যগুরুর প্রতিটি পদক্ষেপে প্রতিটি অঙ্গ-সঞ্চালনে সেই বার্তা উঠে আসে। আমরা তখন পাশের মানুষটিকে মানবিক স্পর্ধায় বলতে পারি, আছে, আললা আছে সব অবভাস পেরিয়ে।

 এমন উচ্চারণে স্থিতধী আত্মদীপ হওয়ার নামই তো সংস্কৃতি। এই হওয়ার আর হয়ে ওঠার কোনো সমাপ্তিবিন্দু নেই, নতুন নতুন আরম্ভ আছে শুধু। সব ধরনের ধারাবাহিকতা মুছে ফেলার সন্ত্রাসী চক্রান্ত সত্ত্বেও ফিরে দেখা আছে। বাঙালির তিন ভুবনে রূপকথার রাক্ষসখোসদের নিদালির মন্ত্র আধুনিকোত্তর আঙ্গিকে ব্যবহৃত হচ্ছে। যখন, ঘুমঘোরে অনেকের আত্মা আচ্ছন্ন। ধর্মের মাদক, আঞ্চলিকতার মাদক, বিশ্বায়নের মাদক সুস্বাদু ঘুমের ঘেরাটোপ তৈরি করে দিয়েছে আমাদের জন্যে। আমরা আজ জানি, আমরা কী এবং কারা! কী আমার পরিচয়, মা’ এই অবোধ প্রশ্ন জাগে না বলে মাঝরাতে বারবার ভিত্তারা হতে হয় আমাদের। পাঠ দিতে পারে, দেয় শুধু সংস্কৃতি! বিভাস চক্রবর্তী মাধব মালঞ্চী কইন্যা’ কিংবা হরিমাধব মুখখাপাধ্যায় ‘দেবাংশী’ নাটকে ঐতিহ্যের পুনর্নির্মাণকে প্রয়োগের মৌল আধেয় করে তোলেন আর সেলিম আলদীন পরম্পরার নিবিষ্ট পুনঃপাঠে নাট্যবস্তুকে আধারিত করেন-বুঝে নিই, আমরা যা ছিলাম তাতেই তারা অস্তিত্বের নির্যাস সন্ধান করেন। শওকত আলী যখন তন্নিষ্ঠ আন্তরিকতায় তুর্কি আক্রমণের অব্যবহিত পূর্ববর্তী বাংলাদেশের উপন্যাসবীজ আহরণ করে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ লেখেন কিংবা সেলিনা হোসেন ‘নীল ময়ূরীর যৌবন লেখার জন্যে চর্যাপদের সময় ও পরিসরকে নতুনভাবে পুনর্গঠন করেন-বুঝি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের প্রতিবেদনে শেষ কথা নেই কোনো। আছে শুধু প্রাক্তন আলোক-উৎস থেকে দীপ জ্বালানো নবীন অধ্যবসায়। আর, এভাবে নিজেদের পরিচয় যাচাই করে নেওয়া। যে-পথ হারিয়ে গেছে কখননা, সে-পথে পুরনো রীতিতে। পথিক হওয়া যায় না হয়তো, পথ পুনর্নির্ণয় নিশ্চয় করা যায়। কারণ, শুধু একান্তিক বিচ্ছেকে মান্যতা দিয়ে ইতিহাসের প্রান্ত পাঠ করি; বিচ্ছেদ ও ধারাবাহিকতার দ্বিরালাপ আবিষ্কার করে বরং সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবন ঘটাতে পারি।

 সৃষ্টি এভাবেই হতে পারে, হয়ে থাকে। কেননা সার্থক সৃষ্টি কোনোনা-কোনোভাবে পুনঃসৃষ্টি মাত্র। অস্তিত্বের অনুশীলন করে সংস্কৃতির আনন্দকুসুম ফুটিয়ে তোলা। এ যে আপ্তবাক্য নয়, তার চমৎকার প্রমাণ পেয়েছি বাংলাদেশের বগুড়ায়। ধূসর অতীতের পুণ্ড্রবর্ধন রাজ্যের স্মৃতি বাহ্যত এখন নিরালম্ব। পাহাড়পুর বিহার ও মহাস্থানগড়ের প্রায় অদৃশ্য ধ্বংসাবশেষে আর শীর্ণকায়া করতোয়া নদীর প্রায়-অনুপস্থিত উপস্থিতিতে ইতিহাসের সমস্ত চিহ্নায়ক কার্যত বিলুপ্ত। তবু সন্দেহ নেই, বগুড়ার আকাশে-বাতাসে স্পন্দিত অনুরণিত হচ্ছে ইতিহাস। একবার (২৩ অক্টোবর, ১৯৯৯) ইংরেজ আমলের জরাজীর্ণ প্রেক্ষাগৃহে ‘কথা পুণ্ড্রবর্ধন’ নামে নাটক দেখার সুযোগ হয়েছিল। কার্তিক মন্দিরের দেবদাসী কমলা ও কাশ্মীরের সিংহাসনচ্যুত রাজা জয়াপীড়ের শিল্পিত প্রেম, পুণ্ড্রবর্ধনের রাজকন্যার চক্রান্ত, ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র ও বৌদ্ধধর্মের বিরোধ, অন্তঃসারশূন্য আচারধর্ম ও মানবিক উপলব্ধির দ্বন্দ্বের পটে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত জয়াপীড়ের পুণ্ড্রবর্ধন

২৮