পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ওপর শকুন ও হায়েনাদের অধিকার মেনে নিয়েই ওইসব রাষ্ট্র এখন চাইছে অন্তত কয়েক টুকরো মাংস খাওয়ার সুযোগ।

 বড়ো চমৎকার অজুহাত: ইরাকের পুনর্গঠন। বারো বছর ধরে যাদের ভাতে মেরেছে মার্কিন প্রভুত্ববাদ, সেই ছিবড়ে হয়ে-যাওয়া ইরাকিদের ওপর হাজার হাজার বোমা ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষণ করে, তাদের পাঁচ হাজার বছরের সভ্যতা ও সংস্কৃতির নিদর্শন ধ্বংস কিম্বা লুণ্ঠন করে দেখাতে চাইছে, যার শিল তারই নোড়া তারই ভাঙি দাঁতের গোড়া: এই হবে একুশ শতকের একমাত্র নীতি। ইরাকের অফুরন্ত তরল সোনা এখন থেকে ওই পুনর্গঠনের সূত্রে মজুত হবে মার্কিন প্রভুর ভাঁড়ারে। স্বাধীনতা বা মুক্তি এখন শয়তানের পদাবলী; চরম ঔদ্ধত্য নিয়ে মার্কিন ঘাতকেরা অশ্বেতাঙ্গ দেশে-দেশে ঝাপিয়ে পড়বে। অজগর সাপের ঐক্যনীতি অনুযায়ী গিলে খাবে প্রতিটি দুর্বল দেশের সার্বভৌমত্ব। ওরা প্রয়োজন মতো সত্য, মুক্তি ইত্যাদি উৎপাদন করবে। সর্বাধুনিক তথ্য-বিনোদন প্রযুক্তির মায়ায় আচ্ছন্ন জনদের মনে দৃঢ় প্রোথিত হয়ে গেছে নব্য উপনিবেশ। এরা ডলারের মেকি স্বপ্নে বুদ হয়ে বিশ্বায়নের স্তোত্রপাঠক হতে পারে। একই ছাঁচে ঢালাই হয়ে ইতিমধ্যে যাবতীয় উচ্চাবচতা মুছে যেতে বসেছে। সার্বভৌমত্ব এখন অনাবশ্যক যেহেতু আমেরিকার ইচ্ছাই বিশ্ব জুড়ে একমাত্র আইন। ইরাকের ঘটনাবলী বহু কিছু চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করে গেছে।

 আধুনিকোত্তর রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব, দর্শন, জীববিশ্ব, ব্যবহারবিধি ইত্যাদি নিয়ে যাঁরা অদূর ভবিষ্যতে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তত্ত্বকথা লিখবেন, তাদের ‘নিরপেক্ষতা বা ‘দায়বদ্ধতা নিয়ে হয়ত বা চুলচেরা বিতর্ক হবে। কিন্তু এইসব কী কাজে লাগবে বসরায়-বাগদাদে মৃত কিংবা মৃতবৎ পঙ্গু হয়ে-যাওয়া নারী-শিশু ও সর্বস্বান্ত জনদের? নাকি সাময়িক উত্তেজনার আগুন-পোহানো শেষ হয়ে গেলে ভোগবাদী জমানার প্রতীত বাস্তবে প্রতীত নাগরিক শুধু হতে থাকবে আমজনতা! পি-পু-ফি-শু নীতি অনুযায়ী মার্কিন প্রভুদের চরণদাস হওয়ার জন্যে নিবেদিত হবে কি আমাদের সমস্ত অধ্যবসায়? তাহলে ইতিহাস মুছে যাবে এখন, এই নির্মানবায়ন প্রক্রিয়ার তুমুল সন্ত্রাসে? এই জিজ্ঞাসার সম্ভাব্য মীমাংসা আমাদের কাছই রয়েছে, অন্য কোথাও নয়। দানবিক শক্তির দম্ভে যারা স্বাতন্ত্র-স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব-মানবিকতাকে বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্রের আগুনে ইন্ধন করে তুলেছে—এরাই আবার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বনাম সাধারণ জনগণের বিশ্বব্যাপ্ত প্রধান দ্বন্দ্বকে প্রকট করে তুলছে। দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের মধ্য দিয়ে মুক্তিকামী মানুষের ক্রমিক অগ্রগতির সত্য এই মুহূর্তে মিথ্যা প্রচার ও বারুদের কটু ধোঁয়ায় যতই ঝাপসা হতে দেখি না কেন, শেষ কথা মানুষই বলবে নিশ্চয়। বস্তুত এই ধোঁয়াশার মধ্যেও দেশে-বিদেশে শান্তিযোদ্ধা সংস্কৃতি-শ্রমিকেরা একজোট হয়েছেন, পথে-পথে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। ইঙ্গ-মার্কিন প্রভুত্ববাদের নয়া সাম্রাজ্যবাদী অপচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে তীব্র ঘৃণা ও ক্রোধ প্রকাশ করেছেন।

 একুশ শতকের তৃতীয় বছরে প্রমাণিত হলো, এই নতুন শতাব্দীতে সমগ্র মানব জাতির ঘৃণ্যতম শত্রু হলো বোম্বেটের দল। সমাজতান্ত্রিক কাঠামো ধ্বসে যাওয়ার পরে

৪৫