পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

অস্তিত্বের বোধে পুনঃদীক্ষিত হতে পারি যদি, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিভ্রান্তিকে। অনেক কার্যকরী ভাবে প্রতিহত করতে পারব। এ ব্যাপারে বরাক উপত্যকার মতো প্রান্তিক জনপদের সংগ্রামী মানুষেরা অবিভাজ্য বাঙালি সত্তার নিরীক্ষা-সংকট-উত্তরণ সম্পর্কে মূল্যবান উপলব্ধির সংকেত যোগান দিতে পারেন।

 কালের যাত্রার ধ্বনি সবাই শুনতে পান না: অস্বস্তিকর এই সত্য মেনে নিতে হয়। আত্মবিস্মৃতির আয়োজন আঞ্চলিক-জাতীয়-আন্তর্জাতিক স্তরে এত নির্বাধ যে মেকি ইংরেজিয়ানা ও মোটা দাগের হিন্দিয়ানা, বিশেষভাবে তরুণ প্রজন্মকে, প্রায়-সম্পূর্ণ অনিকেত করে দিয়েছে। ব্যক্তি-জীবন ও সামাজিক অস্তিত্ব থেকে ভাবাদর্শের প্রাসঙ্গিকতা নিঃশেষে মুছে দিয়ে আমরা এখন বিশ্বায়নের সর্বগ্রাসী ভোগবাদ ও পণ্যদেববাদের গোলকধাঁধায় হারিয়ে গেছি। ১৯ মে-র এগারো জন শহিদের বুক-মাথা ফুটো-করে দেওয়া বলেটের হিংস্র শিস আমরা কেউ শুনতে পাই না। শুনতে পাই না ১৯৭২ সালের ১৭ আগস্ট ও ১৯৮৬ সালের ২১ জুলাই তারিখে শহিদ হওয়া আরও তিনজন মৃত্যুজিৎ তরুণের বার্তা। দেখতেও পাই না কোথায় অন্ধকারের শুরু আর কোথায় শেষ। আমরা বধির, আমরা অন্ধ। আমরা সেই জগদ্দল পাথর, সময়-শৈবাল যাদের ঢেকে দিয়েছে। তারিখ কি কেবলই তারিখ, ক্যালেণ্ডার থেকে ঝরে—যাওয়া যে-কোনো একটি পাতা?

 ‘মনে হয় অজন্ম মৃত্যুরে পার হয়ে আসিলাম আজি নব প্রভাতের শিখর চূড়ায়’—রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এরকমও বলা কঠিন। যদিও গত কয়েক বছরে বরাক উপত্যকায় ১৯ মে যথেষ্ট উৎসাহের সঙ্গে পালিত হচ্ছে এবং অন্তত কয়েক বছর ধরে কলকাতায় এবং পশ্চিমবঙ্গের অন্য দু-তিনটে জেলা শহরে এদিন কিছু কিছু অনুষ্ঠান হচ্ছে—তবু বলা যায়, ১৯-এর চেতনা আজও প্রাপ্য মর্যাদা পায়নি। পায়নি কারণ দিনটির ঐতিহাসিক তাৎপর্য গভীরভাবে ভেবে দেখার মতো অবসর বাঙালি বুদ্ধিজীবীর আজও হয়নি। আসলে ইতিহাসও মূলত এক প্রতিবেদন যাকে অনুভূতি দিয়ে আন্তরিকতা দিয়ে অধ্যবসায় দিয়ে গড়ে তুলতে হয়। ইতিহাসের কাছে তেমন কোনও দায় বোধ করিনি বলেই এই সেদিন পর্যন্ত স্বরচিত হিম নীরবতার দুর্গে স্বেচ্ছাবন্দী ছিলাম আমরা।

 মাত্র ক’বছর হল, বরাক উপত্যকায় ভাষা-সংগ্রাম সম্পর্কে কিছু কিছু তথ্য ও স্মৃতিচারণ মূলক বই বেরিয়েছে। এইসব উদ্যমের প্রশংসা করেও বলব, এদের একটিও পূর্ণাঙ্গ নয়। কেননা কোথাও নৈর্ব্যক্তিকতার অভাব খুব প্রকট আর কোথাও নিরপেক্ষতার। ১৯৬১-এর ঐতিহাসিক ভাষা-আন্দোলনে আসামের অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি সূচনাপর্বে হয়তো বিভ্রান্তির পরিচয় দিয়েছিল কিন্তু ক্রমশ জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের প্রভাবে সেই বিভ্রান্তি অনেকখানি কেটেও গিয়েছিল। এই বিষয়টি জেনেশুনে যাঁরা চেপে যেতে চান, তারা ভাষা-সংগ্রামে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকাকে সামান্যতম স্বীকৃতি দিতেও নারাজ। এর প্রভাব স্পষ্টত পড়েছে ভাষা-সংগ্রামের

৫৫