পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

হবে, তারাই বাংলা সাহিত্যের প্রকৃত জীবনঘনিষ্ঠ ও চিরসজীব ধারা প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে এগিয়ে যেতে পারবেন। হ্যাঁ, এটা যুদ্ধই, যদিও অসম যুদ্ধ। একদিকে সর্বগ্রাসী বিদূষণের স্নায়ুকেন্দ্র ও প্রসারণশীল পরিধি নির্মাতা বৃহৎ পুঁজি এবং তার আন্তর্জাতিক মোড়লপ্রভুর জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে ব্যাপ্ত মগজ-ধোলাইয়ের ব্যবস্থা, অন্যদিকে সাংস্কৃতিক রাজনীতির বহুস্বরিক বিচ্ছুরণ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল লিখনযোদ্ধারা। যুদ্ধটা কঠিন, সত্যিই কঠিন। কারণ, ওই যোদ্ধাদের মধ্যেও কেউ কেউ লোভ ও অবসাদের হাতছানিতে কিংবা নান্দনিক ও সামাজিক ভাবাদর্শের ভিত্তিগত শৈথিল্যে যুদ্ধ আরম্ভ করেও শেষ রক্ষা করতে পারেন না। পিছিয়ে পড়তে-পড়তে একসময় চলাটা-ই থামিয়ে দেন। নয়তো শিবির পালটে ভিড়ের দৃশ্যে ঢুকে পড়েন। ফলে যাদের মশালচি হওয়ার কথা ছিল,তারা স্থিতাবস্থাপন্থীদের ঢোল-শোহরতে মৃদঙ্গবাদক হয়ে পড়ে।

 বরাক উপত্যকার লিখিয়েদের যুদ্ধ আরও একটু কঠিন এইজন্যে, যে, প্রাক্-আধুনিক। ও অবক্ষয়ী আধুনিক, সামন্তবাদ ও মুৎসুদ্দি পুঁজিতন্ত্র এখানে সহাবস্থান করে। ফলে স্ববিরোধিতা ও অনন্বয় এখানকার মূলত মধ্যস্বত্বভোগী সমাজে এবং ব্যক্তি-অস্তিত্বে সবচেয়ে প্রবল। এই সব কিছুর মোকাবিলা করে প্রতিকূল পরিবেশে লেখার স্থাপত্য গড়ে তুলতে হয়। ছোট পত্রিকার সলতে যত পোড়ে, আগুন তত জ্বলে না। এক দশকের অনেক আগেই দল ভেঙে যায় এখানে। সাম্প্রতিক সময়-স্বভাব সম্পর্কে অন্ধতা যাতে সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে, মৌলবাদ ও আঞ্চলিক প্রভুত্ববাদ সেই চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখে না। আধা-ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিতে জীবিকার ক্ষেত্রগুলি ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। এই সমাজ থেকে উঠে-আসা লিখিয়েদের এমন আত্মক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয় যে তারা চাইলেও সব-সময়ের-লিখিয়ে হতে পারেন না। অথচ আংশিক সময়ের লিখিয়ে হয়ে থাকায় ঈপ্সিত মাত্রায় যুদ্ধে যোগও দিতে পারেন না। অনতিক্রম্য এই কূটাভাস থেকে মুক্ত হতে-না-পেরে কেউ কেউ বহু হাত-ফেরতা ছদ্ম-আধুনিকতার রঙিন মুখোশ পরে নেন। অন্য অঞ্চলের লিখন-যোদ্ধাদের এত জটিলতার মুখোমুখি হতে হয় কি? তবু এখানে চার দশক ধরে ‘সাহিত্য পত্রিকা নিরবচ্ছিন্ন যুদ্ধ চালিয়ে যায়। অতন্দ্র-শতক্রতু-ইত্যাদি-প্রতিস্রোত-শরিক এর মতো ছোট পত্রিকা কীভাবে যেন ধারাবাহিকতা বজায় রাখে! মশাল মিছিলে পুরনো কিছু অবয়ব ঝাপসা হয়ে গেলেও নতুন-নতুন অবয়ব অন্ধকার চিরে এগিয়ে যায়, এখনও!

 বরাক উপত্যকার বাঙালি লিখিয়ের পক্ষে লেখা বেঁচে থাকার ঘোষণা, স্বতন্ত্র অস্তিত্বের অভিজ্ঞান; এ কোনো অবকাশ বিনোদন বা খামখেয়ালি কাজ নয়। তাই নিজেকে বঙ্গীয় ভুবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্রমাণ করতে লেখেন কবি ও গল্পকারেরা। কোথাও প্রকাশন সংস্থার সমর্থন নেই, দুয়োরানির ছেলে-মেয়েদের প্রতি সুয়োরানির ছেলে-মেয়েদের নিষ্ঠুর ঔদাসীন্য ও তাচ্ছিল্য আছে বরং। তাই নির্বাসিত ঈশান বাংলার সমান্তরাল অপর অস্তিত্বের বেদনা ও অভিমান অতি সম্প্রতি অসাধারণ কথায়-সুরে-গায়কিতে ব্যক্ত হয়েছে—

৬৩