পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 বরাক উপত্যকায় প্রায় চার দশক ধরে লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করে যিনি বিকল্প সাহিত্যের আন্দোলনকে নতুন মাত্রায় উত্তীর্ণ করেছেন, তিনি সাহিত্য সম্পাদক বিজিকুমার ভট্টাচার্য। কোনো বিজ্ঞাপন নেই, অনুকূল সমাজের সমর্থন নেই, বিশেষ কোনো পৃষ্ঠপোষকতাও নেই। অথচ ‘সাহিত্য পরপর বেরিয়েই চলেছে। এই নিরিখে জামশেদপুরের ‘কৌরব’ কিংবা কলকাতার কবিতা পাক্ষিক’ এর সঙ্গে তুলনীয় নয়। কারণ, এদের প্রধান ভরসা বৌদ্ধিক ও আর্থিক সমর্থনের নিশ্চয়তা। হাইলাকান্দির ‘সাহিত্য’ তা কখনও পায় না; অ থেকে চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত সবটাই তার যুদ্ধ। রূপক এবং আক্ষরিক দুই অর্থেই। বিজিৎ ‘সুরক্ষিত বন্দিশালা’নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন ছাব্বিশ বছর আগে। যারা অপর পরিসরের বাসিন্দা হিসেবে অকারণ হীনমন্যতার শিকার, ওই প্রবন্ধটি তারা এখনও পড়তে পারেন। নিছক মফঃস্বলবাসীর বেদনা বলে তার বয়ানকে লঘু করতে নয়, নির্বাসিত ঈশান বাংলার প্রান্তিকায়িত পরিসর থেকে উৎসারিত উচ্চারণ হিসেবে আত্মমর্যাদার ক্ষেত্রগুলি চিহ্নিত করতে।

 বিজিৎ লিখেছিলেন: ‘একথা আজকাল প্রায় সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক পাঠক—অর্থাৎ সাহিত্য-বিচারে যাঁদের ভোটাধিকার অর্জিত হয়েছে—জেনে গেছেন যে বর্তমান বাংলা কবিতার যা মূল্যবান অংশ তার অর্ধেকটা (হয়ত বেশি-ই বলা হলো) যদি বা কলকাতার বহু-পরিচিত কবিদের রচনা, বাকি অর্ধেক নিশ্চিতই রচিত হচ্ছে এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বহু অখ্যাত অথবা অল্পখ্যাত কবিদের হাতে।

 বিজিৎ-এর মন্তব্যের পরিধি একটু সম্প্রসারিত করে বলব, ‘অল্পখ্যাত’ কিংবা ‘অখ্যাত’ গল্পকারদের মধ্যেও বাংলা সাহিত্যের প্রকৃত জীবন্ত ধারাগুলিকে শনাক্ত করা সম্ভব। তুলনামূলক ভাবে অনেক কম সংখ্যায় হলেও একথা প্রাবন্ধিক এবং ঔপন্যাসিকদের সম্পর্কেও প্রযোজ্য। প্রাতিষ্ঠানিক পণ্য-সাহিত্যের গৎবাঁধা পথে যাঁরা চলেন, ছোট পত্রিকা থেকে তারা অবধারিত ভাবেই ছিটকে বেরিয়ে যান। এদের কথা বিজিৎ ভাবেননি, আমরাও ভাবছি না। পেশাদার সাহিত্যিকদের কিংবদন্তিতুল্য ভাবমূর্তি। কিংবা জীবনযাপন মফঃস্বলের তরুণদের আচ্ছন্ন করে, এটা ঠিক। কিন্তু অমুক চন্দ্র তমুকের মতো লিখতে যারা সচেতন বা অবচেতন ভাবে প্ররোচিত হয়, ভরাডুবিই তাদের নিয়তি। বরাক উপত্যকার শক্তিপদ বা শেখর নিজস্ব কাব্যভাষা বা গল্পভাষা যদি আবিষ্কার করতে না পারতেন, নির্মম সময় তাদের কবেই পথপ্রান্তে ফেলে রেখে যেত। লেখার জগতে কোনো মমতা, সহানুভূতি, পক্ষপাতিত্ব অচল। প্রতিইঞ্চি জমি প্রণালীবদ্ধ মেধাবী অধ্যবসায় দিয়ে অর্জন করতে হয়। বিজিং ‘সাহিত্য পত্রিকায় তা করেছেন। আর তাই তাঁকে নিছক বরাক উপত্যকার পরিধিতে বিচার করা চলে না। বৃহত্তর বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষিতে বালুরঘাটের ‘মধুপণী’ সম্পাদক অজিতেশ ভট্টাচার্য, মেদিনীপুরের ‘অমৃতলোক’ সম্পাদক সমীরণ মজুমদার, বগুড়ার ‘নিসর্গ’ সম্পাদক সরকার আশরাফ, গৌহাটির ‘একা এবং কয়েকজন’সম্পাদক উদয়ন বিশ্বাস ও পূর্বদেশ’ সম্পাদক অখিল দত্ত, ঢাকার ‘একবিংশ’ সম্পাদক খোলকার আশরাফ হোসেন, কলকাতার এবং

৬৫