পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

মুশায়েরা’ সম্পাদক সুবল সামন্ত, ‘তমসুক’ সম্পাদক সমীর চট্টোপাধ্যায় এবং এরকম আরো কয়েকজনের গৌরবময় অভিযাত্রায় তিনি সংশ্লিষ্ট হয়ে যান।

 বিভিন্ন পর্যায়ে বরাক উপত্যকার ছোট পত্রিকার জগৎ থেকেই তো পেয়েছি উদয়ন ঘোষ, রুচিরা শ্যাম, শান্তনু ঘোষ এবং বিশেষত রণজিৎ দাশের মতো কবিকে। প্রথম তিনজন সূচনাপর্বে চোখ ধাঁধিয়েও আংশিক সময়ের লিখনকর্মী হওয়াতে সৃষ্টি-প্রকল্প থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ালেন। কিন্তু রণজিৎ নিজেকে মুহুর্মুহু বিনির্মাণ করে বাংলা কবিতার আবহমণ্ডলে অন্যতম প্রধান জ্যোতিষ্ক হয়ে উঠতে পারলেন। শান্তনু নিজের জন্যে আয়না আনতে আনতে মাঝপথেই গুড়িয়ে দিয়েছিলেন; আত্মপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে সাহিত্য পরিত্যক্ত হল বলে এই বাচনও কোথাও পৌছাল না। প্রান্তিক মানুষের উচ্চারণে সময়ও পরিসরের অনন্বয় কত নতুন তাৎপর্য এবং অভিনব উপস্থাপনা-পদ্ধতির উৎস হয়ে উঠতে পারে, তাও জানা হল না। এ কেবল ব্যক্তিগত অবসাদের বৃত্তান্ত নয়, প্রান্তিক পরিসরের মধ্যবিত্তবর্গীয় বৌদ্ধিক অস্তিত্বের সীমাবদ্ধতা এভাবে চিহ্নায়িত হল যেন। বৃত্তবন্দী কক্ষপথ চূর্ণ করার প্রতিশ্রুতি জাগিয়েও শুধুমাত্র যথাপ্রাপ্ত অবস্থানের অন্ধবিন্দুর দুর্মর উপস্থিতি কল্পনাপ্রতিভাকে শুষে নেয়—এই বার্তা কেবল বরাক উপত্যকার পক্ষে প্রাসঙ্গিক নয়। সমস্ত প্রান্তিক পরিসরের সৃষ্টি-প্রয়াসীদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ সতর্কীকরণও। আর, পাশাপাশি,বৃত্তবন্দিত্ব থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন বলে রণজিৎ তারুণ্যের অহংকারে যেমন লিখেছিলেন (রোম থেকে শিলচর একটানা রেলপথ হবে)—সেই চিহ্নায়িত সার্থক হয়ে উঠল। ঘটাকাশ মিশে গেল মহাকাশে। বরাক উপত্যকায় যারা জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে রয়ে গেলেন, তাঁদের পক্ষে শান্তনু ও রণজিৎ যেন দুই মেরুর দুটি সংকেত হয়ে উঠলেন। যাঁরা বহুমাত্রিক ভাবে মহাকাশের বার্তা ধারণ করতে পারলেন পরিসর-লালিত আধারে, তারাই বাংলা ভাষার আঞ্চলিক লাবণ্যের প্রতিমা গড়তে পারলেন। কেউ বা মনোযোগী হলেন লোকায়ত চালচিত্রে, কেউ বা চালচিত্রে সময়ানুভবের আন্তর্জাতিক চিহ্নায়ক মুদ্রিত করতে চাইলেন।

 প্রতিবেশী ত্রিপুরায় ছোটগল্প ও উপন্যাস যেমন অপর পরিসরের সমান্তরাল অস্তিত্বকে কিছু কিছু সার্থক পাঠকৃতিতে রূপান্তরিত করে চলেছে, সেই মাত্রায় -হলেও বরাক উপত্যকায় অনিশ-শতক্রতু-অক্ষরবৃত্ত-প্রতিস্রোত-সাহিত্যকে কেন্দ্র করে কথাসাহিত্যের লক্ষণীয় বিন্যাস-প্রতিন্যাস গড়ে উঠেছে। শ্যামলেন্দু চক্রবর্তী-মিথিলেশ ভট্টাচার্য-বদরুজ্জামান চৌধুরী-অরিজিৎ চৌধুরী-দেবব্রত চৌধুরী-মলয়কান্তি দের-র মতো গল্পকারদের নিজস্ব গল্পসংকলন আজও প্রকাশিত হল না—এ কোনো বিস্ময় নয়। অনীহা ও উদ্যমহীনতার হিমানী সম্প্রপাতে নিঃশব্দে ডুবে যায় সব অধ্যবসায়। বরাক উপত্যকার নির্বাচিত গল্প কিংবা উত্তরপূর্বাঞ্চলের গল্প: এই দুটি সংকলন এখানকার সবেধন নীলমণি। আবারও লিখতে হচ্ছে, আংশিক সময়ের লেখক হয়ে থাকতে থাকতে এখানকার গল্পকারদের মধ্যে কুয়োবাসীর যাবতীয় ভনিতা পাকাপোক্ত হয়ে গেছে। শেখর দাশের ‘কোষাগার’, রণবীর পুরকায়স্থের ‘বোকা কাশীরাম কথা’, সুব্রত কুমার রায়ের ‘আরশিনগরের রূপকথা’, অমিতাভ দেবচৌধুরীর

৬৬