পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ভাষা-উপভাষা-বিভাষার সমৃদ্ধি পৃথিবীর ভাষাভুবনে বাংলাকে অনন্য করে তুলেছে। কিন্তু কলকাতা-কেন্দ্রিক কিছু বাঙালির কাছে মান্য চলিতের বাইরে সব কিছুই দূরবর্তী ও প্রত্যাখ্যানযোগ্য অপর।‘ওরা’ ব্রাত্য, ওদের উপেক্ষা ও তাচ্ছিল্য করা চলে। এমন কী, ‘ওদের’ অস্তিত্ব অস্বীকার করলেও ক্ষতি নেই কিছু।

 এই বিমূঢ়তার একটা অভিব্যক্তি দেখেছি অতি সম্প্রতি। বাংলা ভাষার স্বয়ম্ভু অভিভাবক হিসেবে উদ্ভূত একটি বৌদ্ধিক গোষ্ঠী ফতোয়া জারি করেছেন, বহির্বঙ্গে যত বাঙালি আছেন তারা সেইসব রাজ্যের সরকারি ভাষায় নিজেদের নিঃশেষে মিলিয়ে দিলেই সমস্যার সমাধান। রবীন্দ্রনাথ কি এ ধরনের মনোভঙ্গিকে ‘অজগর সাপের ঐক্যনীতি’ বলেছিলেন? আসামে অসমীয়া সম্প্রসারণবাদ, বিহারে ও উত্তরপ্রদেশে হিন্দু ফ্যাসিবাদ, ত্রিপুরায় উগ্র আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদ এবং পশ্চিমবঙ্গে আর্যাবর্তের ধর্মীয় মৌলবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করলেই বুঝি জাতীয় সংহতির চরম হবে? বাংলা ভাষা ও বাঙালি নিয়ে কথা বলার কোনও নৈতিক অধিকার এদের কাছে। আছে কি? নেই, কারণ এদের জন্যেই বাঙালির পরিসর ক্রমাগত সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। স্বেচ্ছায়, সানন্দে নিজেদের ঘাড় এঁরা এগিয়ে দিচ্ছেন গিলোটিনের দিকে। অবশ্যই সেই গিলোটিন চালানোর দায়িত্ব তাদের হাতে রয়েছে, ইতিহাসে যারা অজস্র অসংখ্যবার বাঙালিত্বের পরিসরকে খর্ব করে এসেছে। কিছুদিন আগে বিখ্যাত-এক সাহিত্যপত্রে নামজাদা এক প্রাবন্ধিকের পিলে-চমকানো রচনা পড়লাম। তার মতে, রাষ্ট্র বা রাজ্যের সীমা তো কিছুদিন পর-পর বদলে যেতেই পারে। আবারও যদি পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্র পাল্টে যায়, মহাভারত এমন কী আর অশুদ্ধ হবে! বলিহারি! নিজের হাত দিয়ে নিজেরই নাক-কান কাটতে এত দক্ষতা বাঙালি ছাড়া আর কার থাকবে। এই যুক্তিতে গোখাল্যাণ্ড হোক, ঝাড়খণ্ড হোক, গৌড় হোক, মল্লরাজ্য হোক, পশ্চিমবঙ্গ বলে কিছুই থাকুক, ক্ষতি কী? বুদ্ধিজীবীদের চুলচেরা বয়ান বিশ্লেষণ, মেধাবী বিষাদ ও উল্লাস একই রকম থাকবে। মিথিলা পুড়ে গেলেও আমার কিছুই পুড়বে না’-রাজা জনকের এই উচ্চারণে বৈদান্তিক মায়াবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইদানীং বঙ্গজ পণ্ডিতকুলের বদান্যতায় নব্যমায়াবাদের বাড়বাড়ন্ত দেখছি। এঁদের আরেকটি সর্বজনীন প্রবণতা হল, নিজের চিন্তাকে অকাট্য মনে করা এবং অন্যদের সম্পর্কে সন্দিগ্ধ ও উদাসীন থাকা; চরম বিচ্ছিন্ন গজদন্তমিনারে বসে এঁরা ভাবনার অপরতার প্রতি অসহিষ্ণুতা দেখিয়ে অন্য সমস্ত অবস্থানকে অনবরত তিক্ত আক্রমণ করে যান।

 আত্মহননে মাতোয়ারা ও চূড়ান্ত একদেশদর্শী এইসব বুদ্ধিজীবীরা যখন জনসংখ্যা বৃদ্ধির যুক্তি দেখান, তারা কি ইতিহাস ও ভূগোলের সব অনুপুঙ্খ লক্ষ করেন কিংবা একই যুক্তি পশ্চিমবঙ্গ বহির্ভূত বাঙালির ক্ষেত্রেও (আসাম-ত্রিপুরা) প্রয়োগ করেন? বোধহয় না। গোর্খাল্যাণ্ডের সীমানা সমভূমি পর্যন্ত যাতে প্রসারিত হতে পারে, সেই লক্ষ্যে অত্যন্ত প্রণালীবদ্ধ ভাবে নতুন বসতি তৈরি করা হয়েছিল। এ বড় বিপজ্জনক

৭২