পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

অতীতের মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে মিথ্যা আত্মীয়তা গড়ে তুলতে চাইল। আরবি ও পারসিক কাহিনির ছায়ায় খুঁজে নিতে চাইল। মানসিক আশ্রয়। সাহিত্যের নির্মিতি আর জীবনের যথাপ্রাপ্ত বাস্তব হিন্দু বাঙালি ও মুসলমান বাঙালির পক্ষে এত দ্বিমেরু-বিষম ছিল যে কোনওভাবেই এদের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করা সম্ভব ছিল না।

 কিন্তু মানসিক বিরুদ্ধতা কোনও পক্ষই কিছুতে কাটিয়ে উঠতে পারলেন না। কেননা হিন্দু হিন্দুই রয়ে গেল এবং উত্তরোত্তর আরও ‘শুদ্ধতর’ হিন্দু হয়ে ওঠার জন্যে আর্যাবর্তের ক্রমবর্ধমান চাপের কাছে বাঙালিত্বের স্বাভাবিক অভিজ্ঞানগুলি মুছে ফেলতে লাগল। আর, মুসলমান সমাজের নেতৃবৃন্দ রাজনৈতিক মুনাফার জন্যে, তাদের দেশজ শেকড় ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টায়, মাতৃভাষা সম্পর্কেও বিরুদ্ধতা তৈরি করতে থাকলেন। সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে আত্মজিজ্ঞাসা জাগিয়ে দেওয়ার বদলে আত্মবিস্মরণ সংক্রমিত করার মরিয়া চেষ্টা চলতে লাগল। কী মুসলমান কী হিন্দুধর্মতন্ত্রের কাছে সংঘবদ্ধ সমর্পণ শুধু অন্ধতা ও অসহায়তা উৎপাদন করে। ধর্মকে যারা কাজে লাগায়, বদ্ধতাই তাদের অস্ত্র ও অন্বিষ্ট; একমাত্র সদর্থক ভাষা-চেতনাই দিতে পারে মুক্তি। তাই ভালো বাঙালি যে হতে পারে, সে-ই ভালো মানুষ হয়ে ওঠে। হিন্দুত্ব ও মুসলমানত্বের দিকে বেঁকে গেলে সেই পথ চোরাবালিতেই শেষ হয়। বাঙালি যে আন্তর্জাতিক মানবচেতনার উপাসনা করে, নিছক হিন্দু বা মুসলমান হয়ে উঠলে তা কখনও সম্ভব নয়। এইজন্যে নয়া ঔপনিবেশিক প্রতাপের বিশ্বকেন্দ্র গত তিন-দশক ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে চতুরভাবে হিন্দু ও ঐশ্লামিক মৌলবাদকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে। খাটি বাঙালি যে কখনও মৌলবাদী হতে পারে না, তা বাঙালির ইতিহাস ঠিক মতো অনুশীলন করলেই বোঝা যায়। তাই আর্যাবর্ত-মধ্যপ্রাচ্য-সাম্রাজ্যবাদী প্রতীচ্য—এই তিন অক্ষশক্তির একটাই লক্ষ্য: বাঙালিত্বকে ধ্বস্ত করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির তুষের আগুন ছড়িয়ে দেওয়া। বাঙালি চেতনায় যাবতীয় মিথ্যার প্রকৌশলের বিরুদ্ধে একটা সহজাত প্রতিরোধ আছে বলেই ওই অক্ষশক্তি পশ্চিমবঙ্গে, বাংলাদেশে ও বাঙালির অন্যভুবনে তাদের আক্রমণকে কখনও শিথিল করে না। তবু সর্বাত্মক বিদূষণের বিরুদ্ধে দৃপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গ যে আজও প্রতিরোধের লড়াই-এ নেতৃত্ব দিচ্ছে, এতেই বাঙালির প্রবল আত্মিক শক্তি প্রমাণিত। পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ, আঞ্চলিকতাবাদ ও সন্ত্রাসবাদ যে কিছুদিন আগে পর্যন্ত মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি—এর কারণ, রাজনৈতিক লড়াই ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামকে গরিষ্ঠ সংখ্যক বাঙালি তখন শানিততর করে চলছিলেন। চলমান ইতিহাসের অস্থির পটভূমিতে দাঁড়িয়েও বাঙালির প্রগতি-ভাবনা এখনও চেতনাকেন্দ্র সম্পর্কে দ্বিধাগ্রস্ত নয়। বহুস্তর বিন্যস্ত সংগ্রামের ভিন্ন ভিন্ন পরিধি ও ভিন্ন ভিন্ন উপকেন্দ্র সম্পর্কে মনোযোগী হয়েও মূল ভাবকেন্দ্রকে চিরজাগ্রত রাখার ব্যাপারে প্রগতিশীল পশ্চিমবঙ্গ অমনোযোগী ছিল না কখনও।

 বস্তুত এইজন্যে প্রত্যাশাও অনেক। কোথাও অন্ধবিন্দুর আশঙ্কা লক্ষ করলে সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই হয়। ভারতীয়ত্ব নির্মাণ করতে হয়, কিন্তু বাঙালিত্ব সহজ ও

৭৫