পাতা:সাহিত্য-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৪৭

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
বঙ্গভাষা ও সাহিত্য
১৩৯

 এক-এক সময়ে এক-এক দেবতা বড়ে। হইয়া অন্যান্য দেবতাকে কিরূপে গ্রাস করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, এই গল্পেই তাহা বুঝা যায়। ব্রহ্মা, যিনি চারি বেদের চতুর্‌মুখ বিগ্রহস্বরূপ, তিনি বেদবিদ্রোহী বৌদ্ধ যুগে অধঃকৃত হইয়াছিলেন। বিষ্ণু, যিনি বেদে ব্রাহ্মণদের দেবতা ছিলেন, তিনিও এক সময়ে হীনবল হইয়া এই শ্মশানচারী কপালমালী দিগম্বরের পশ্চাতে আশ্রয় লইতে বাধ্য হইয়াছিলেন।

 শিবের যখন প্রথম অভ্যুত্থান হইয়াছিল তখন বৈদিক দেবতারা যে তাঁহাকে আপনাদের মধ্যে স্থান দিতে চান নাই তাহা দক্ষযজ্ঞের বিবরণেই বুঝা যায়। বস্তুতই তখনকার অন্যান্য আর্যদেবতার সহিত এই ত্রিলোচনের অত্যন্ত প্রভেদ। দক্ষের মুখে যে-সকল নিন্দা বসানো হইয়াছিল তখনকার আর্যমণ্ডলীর মূখে সে নিন্দা স্বাভাবিক। সমস্ত দেবমণ্ডলীর মধ্যে ভূতপ্রেত-পিশাচের দ্বারা এই অদ্ভুত দেবতাকর্তৃক দক্ষযজ্ঞধংস কেবল কাল্পনিক কথা নহে। ইহা একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের তুল্য। আর্যমণ্ডলীর যে বৈদিক যজ্ঞে প্রাচীন আর্যদেবতারা আহূত হইতেন সেই যজ্ঞে এই শ্মশানেশ্বরকে দেবতা বলিয়া স্বীকার করা হয় নাই এবং তাহাকে অনার্য অনাচারী বলিয়া নিন্দা করা হইয়াছিল; সেই কারণে তাঁহার সেবকদের সহিত আর্যদেবপূজকদের প্রচণ্ড বিরোধ বাধিয়াছিল। এই বিরোধে অনার্য ভূত-প্রেত-পিশাচের দ্বারা বৈদিক যজ্ঞ লণ্ডলণ্ড হইয়া যায় এবং সেই শোণিতাক্ত অপবিত্র যজ্ঞবেদীর উপরে নবাগত দেবতার প্রাধান্য বলপূর্বক স্থাপিত হয়।

 আর্যদেবসমাজে এই অদ্ভুতাচারী দেবতা বলপূর্বক প্রবেশ করিলেন বটে, কিন্তু ইহাকে অনেক জবাবদিহি করিতে হইয়াছিল। কথাসরিৎসাগরেই আছে, একদা পার্বতী শম্ভুকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘নরকপালে এবং শ্মশানে তোমার এমন প্রীতি কেন?’

 এ প্রশ্ন তখনকার আর্যমণ্ডলীর প্রশ্ন। আমাদের আর্যদেবতারা স্বর্গবাসী; তাঁহারা বিকৃতিহীন, সুন্দর, সম্পৎশালী। যে দেবতা স্বর্গবিহারী নহেন,