পাতা:সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা (একাদশ ভাগ).pdf/১৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কলন ১৩১১ ] নিরক্ষর কবি ও গ্ৰাম্য কবিতা । S8s ঘোর শীতকালের পৌষমাসে খাদ্যদ্রব্যের মধুর আস্বাদন করিতে শীতভয়ে ভীত রবিরাগরঞ্জিত রৌদ্রে বসিয়া উৎসব করিতে প্ৰস্তুত হয়। তাই এই পৌষ সংক্রান্তিতে কৃষকশ্রেণীর যত আনন্দ, অপর উন্নতশ্রেণীর তত নহে। পৌষমােস উপস্থিত হইলে কৃষকশ্রেণীর নিরক্ষর কবিগণ অগ্নিসম্মুখে অথবা কান্থার তলে থাকিয়া আপন আপন প্ৰতিভানুযায়ী কল্পনাদেবীর অনুগ্ৰহে কবিত্বশক্তি স্ফরিত করিতে আরম্ভ করে। শেষে যখন মাসের ১৫ দিন। অতীত হয়, তখন কেহ বালকদল সংগ্ৰহ করিয়া কেহ বা যুবকদল সংগ্ৰহ করিয়া স্ব স্ব কবিতাশক্তির প্রসার বৃদ্ধি করিতে তাহাদিগকে শিক্ষা দিতে থাকে। শিষ্যগণের বা শিক্ষানবীশগণের শিক্ষা পূর্ণ হইলে, স্বয়ং কবি মহাশয় তাহাদিগকে একদিন নিজ বাড়ীতে পরীক্ষা লইয়া সাধারণের নিকট ছাড়িয়া দেন। শেষে অভ্যন্ত যুবক অথবা বালকগণ গৃহস্থের দ্বারে দ্বারে গিয়া গীত গাইতে থাকে। মাসের শেষদিন যখন উন্নতশ্রেণীর গৃহস্থ সাধারণ পিষ্টকাদি খাদ্য আস্বাদন করিতে থাকেন, তখন এই সকল গায়কগণ কোন প্ৰান্তরে গিয়া উৎসব করে। ইহাদের এই উৎসবে অন্য কোন আমোদজনক কাৰ্য্য নাই, কেবল হিন্দুজাতির নিয়শ্রেণীর কৃষকগণ “বাস্তুদেবতা” পূজা উপলক্ষে সময় সময় মেষ বলিদান দিয়া পিষ্টকাদিখাদ্যে তৃপ্ত হইয়া স্থানে স্থানে হরিনামকীৰ্ত্তন করে। আর মুসলমানগণ “পীরের শিনী” দিয়া এক একবার প্রান্তরের মধ্যে “আমিন আমিন” শব্দে উৎসাহসূচক ধ্বনি করে । এই পৌষপার্বণ-প্রক্রিয়া উচ্চশ্রেণীর হিন্দুমুসলমান মধ্যেও বিরল নহে। বঙ্গের এই পৌষপার্বণ অতিপ্ৰাচীন রীতি, তাই বঙ্গীয় কৃষকগণ এই প্ৰাচীন রীতির এত পোষক। এই কারণেই কৃষকসমাজের নিরক্ষর কবির দল এই রীতির উপর অনেক কবিত্বশক্তি প্ৰদৰ্শন করিয়াছেন। যখন পৌষের হাড়ভাঙ্গা শীতে কৃষকবালকগণ দলবদ্ধ হইয়া গৃহস্থের বাড়ীতে বাড়ীতে সোনাহার গাইতে থাকে, তখন দেখা গিয়াছে এই গীতের দলে একটী অপেক্ষাকৃত বয়ঃপ্ৰাপ্ত বালক আগ্ৰে গাইয়া যায়, তাহার পর অপর বালকগণ ঝুমর গাইতে থাকে। যখন সামান্য মলিন বেশধারী বস্ত্ৰাচ্ছাদিত কৃষক পুত্ৰগণ এই গীত গাইতে থাকে, তখন অনেক সময় দেখা যায়, কত কত শিক্ষিত ব্যক্তি এমন কি ভদ্রঘরের অসুৰ্য্যাম্পশ্যা ষোড়শী। রূপসীগণ পৰ্য্যন্ত অতি ঔৎসুক্যের সঙ্গে এই গীত শ্ৰবণ করিয়া থাকেন। ‘সঙ্গীতগুলির মধ্যে শব্দের তত গাম্ভীৰ্য্য নাই। সহজাত সরল শব্দবিন্যাসে রচিত। ভাবের মধুরতা, কৌতুকের কোমলতা এবং আগ্রহের উচ্ছাসে এই সমস্ত গীতি উচ্ছাসিত। যাহারা এই সমস্ত সঙ্গীত রচনা করিয়া দেশের মধ্যে সমশ্রেণীর নিকট গণ্যমান্য হইয়াছে, তাহারা ভদ্র সাধারণের নিকট “চাষাপণ্ডিত” নামে অভিহিত। এই সকল চাষা পণ্ডিতগণ জীবনে কখনো কালিকলম হাতে করে নাই, কেবল প্ৰকৃতিজাত কল্পনাকৌশলে এবং ভাবের আবেগে, २९ কৃষিক্ষেত্রে, কখন নৌকাচালনে, কখন গৃহের বরেণ্ডায়, কখন শস্যের ভার মাথায় করিয়া কোন সময় সমবয়স্কের সঙ্গে পথগমনে এই সকল সঙ্গীত রচনা করিতেছে।