পাতা:সিমার - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

লোকটি বিড়ির কীেটাে থেকে নিজে হাতে বাঁধা কাঁচা বিড়ি বার করে লাইটারের চাকতি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সলতে মুছে ধরিয়ে নেয়, চোখে পিচুটির সাথে বিষন্ন ক্ষুধার্ত জল চিকচিক করছে। বাবেয়া বললে, দেখতে কার মতো বল তো ? সরদীঘার শাদা মিঞার মতো, হুবহু এক দেখতে । আমি প্রথমে চমকে উঠেছিলাম । শাদা মিঞা। এখানে কেন আর শাদা মিঞা ভাববে। আমি এখানে কেন । খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেছি। দেখ না ভালো করে, আদলে ছবিতে সেই একই লোক । আমাদের থেকে বিশ-পঁচিশ বিঘৎ দূরত্বে ওরা বসেছিল। আমাদের কথা হয়তো ওরা একটু শুনতেও পাচ্ছিল । লোকটি বিড়ি টানছিল আর আমাদের দিকে বার বার চেনা মানুষের মতো চেয়ে চেয়ে দেখছিল । লোকটির দুবার বিড়ি নিভে গেল, দু বারই ধরিযে নিল । পা ছড়িয়ে বসেছে মাথায় ঘোমটা টানা কাঁচা যুবতী । কোলে ন্যাকড়ায় জড়ানো মাংসপিণ্ড । বুকের মায় কালো ব্লাউজ থেকে আলগা করে সবজী পাড় শাড়ির আঁচলে বাচ্চার মাথা-গা ঢেকে দুধ দিচ্ছে। বাচ্চাচিনচিনা করে কাঁদোকান্নার সুরে কী দুবোধ্য অভিযোগের ধারালো চিৎকার। আমরা কিছু কৃপণ সুখের তল্লাশে তিন মাসের অপুষ্ট স্বপ্নের হাত ধরে চিতিব দিগন্তে এসেছি, এখানেও কান্নার নিষ্ঠুরতা। ভালোবাসার চকিত রহস্যকে খুঁজে দেখার আকুলতা মনে যে তাগিদ দিচ্ছিল, এখন তা কান্নার দাপটে খানিক বোকা হয়ে গেছে । বললাম, ওদের সাথে একটু কথা বলি ? সেই সব গ্রাম-ঘরের চাচা ফুপাব গুষ্টি, বেদের বাঁশ-নালার মতো সম্পর্ক ধরে এগোলে গেথে ফেলতে কতক্ষণ ! গাঁয়ের মানুষ গায়ে পড়ে ঢালানি করে, শহুরে শিক্ষিতারা বলে, এরা হচ্ছে ভাব-বেশ্যা, এ অপবাদ একদম মিছে নয়। কিন্তু এর যে কী আঠালো রস, শহর তার হদিস পায় না । সম্পর্কের বিশুদ্ধ প্ৰণয়ে গাঁয়ের কোেনা বিশেষ ভক্তি নেই। সম্পর্ক একটা পেলেই হয়, ব্যস থিতু হয়ে বসে একটা বিড়ি ধরিয়ে আলাপে আলাপে বেলা বাড়ে, ফোঁটায় ফোঁটায় রসে কোনো খামতি হয় না। কিন্তু শহরে এ রকম গা আলগা দেয়ার সময় কোথায়, ঘাসের আস্তরণের তলায় তলায় ট্রামের লাইন পাতা, কখন যে পেছনে এসে ট্রাম ঘাণ্টি বাজায়, গাঁয়ের চাষা তড়াক ভুকু উঠে বােকা হয় ভাবে এই হচ্ছে শহর। সাির্কন থাকাই লৈ যাবে তুমি ? রাবেয়া বললে, বাঃ, চমৎকার বলেছ । শহরে এলে বোঝা যায়, মানুষের জীবনটা কতটা সূক্ষ্ম সুতোর উপর ঝুলছে। শহর বলতে অবিশ্যি কলকাতা । V8