পাতা:সীতারাম- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/১১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
তৃতীয় খণ্ড—একাদশ পরিচ্ছেদ
১১১

 সীতারাম চিন্তামগ্ন হইয়া বলিলেন, “বোধ হয় তাই। শ্রী! তোমার মুখ দেখিলে আমি সব ভুলিয়া যাই।”

 শ্রী। তবে, আমার এক ভিক্ষা আছে। এ পোড়ার মুখ, আবার লুকাইতে হইবে। নহিলে সীতারাম রায়ের নামে কলঙ্ক হইবে; ধর্ম্মরাজ্য ছারে খারে যাইবে। আমায় হুকুম দাও, আমি বনে যাই।

 সীতা। যা হয় হোক, আমি ভাবিয়া দেখিয়াছি। হয় তোমায় ছাড়িতে হইবে, নয় রাজ্য ছাড়িতে হইবে। আমি রাজ্য ছাড়িব, তোমায় ছাড়িব না।

 শ্রী। তবে তাহাই করুন। রাজ্য কোন উপযুক্ত লোকের হাতে দিন। তার পর সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়া আমার সঙ্গে বনে চলুন।

 সীতারাম চিন্তামগ্ন হইয়া রহিলেন। রাজার তখন ভোগলালসা অত্যন্ত প্রবলা। আগে হইলে সীতারাম রাজ্য ত্যাগ করিতে পারিতেন। এখন সে সীতারাম নাই; রাজ্যভোগে সীতারামের চিত্ত সমল হইয়াছে। সীতারাম রাজ্য ত্যাগ করিতে পারিলেন না।

একাদশ পরিচ্ছেদ

 সেই যে সভাতলে রমা মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িয়া গিয়াছিল, সখীরা ধরাধরি করিয়া আনিয়া শুয়াইল, সেই অবধি রমা আর উঠে নাই। প্রাণপণ করিয়া আপনার সতী নাম রক্ষা করিয়াছিল। মান রক্ষা হইল, কিন্তু প্রাণ বুঝি গেল।

 এখন রোগ পুরাতন হইয়াছে। কিন্তু গোড়া থেকে বলি। রাজার রাণীর চিকিৎসার অভাব হয় নাই। প্রথম হইতেই কবিরাজ যাতায়াত করিতে লাগিল। অনেকগুলা কবিরাজ রাজবাড়ীতে চাকরী করে, তত কর্ম্ম নাই, সচরাচর ভৃত্যবর্গকে মসলা খাওয়াইয়া, এবং পরিচারিকাকে পোষ্টাই দিয়া কালাতিপাত করে; এক্ষণে ছোট রাণীকে রোগী পাইয়া কবিরাজ মহাশয়েরা হঠাৎ বড় লোক হইয়া বসিলেন, তখন রোগনির্ণয় লইয়া মহা হুলস্থুল পড়িয়া গেল। মূর্চ্ছা, বায়ু, অম্লপিত্ত, হৃদ্রোগ ইত্যাদি নানাবিধ রোগের লক্ষণ শুনিতে শুনিতে রাজপুরুষেরা জ্বালাতন হইয়া উঠিল। কেহ নিদানের দোহাই দেন, কেহ বাগ্‌ভটের, কেহ চরকসংহিতার বচন আওড়ান, কেহ সুশ্রুতের টীকা ঝাড়েন। রোগ অনির্ণীত রহিল।