তৃতীয় খণ্ড—অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ se রক্ষিবর্গ চণ্ডালকে ধরিবার জন্য মঞ্চের উপর আরোহণ করিতে উদ্যত দেখিয়া, জয়ন্তী সীতারামকে বলিলেন, “এ ব্যক্তিকে পীড়ন করিবেন না, আপনার যে আজ্ঞা, আমি নিজেই পালন করিতেছি—চণ্ডাল বা জল্লাদের প্রয়োজন নাই ।” তথাপি রক্ষিবর্গ চণ্ডালকে ধরিতে আসিতেছে দেখিয়া, জয়ন্তী তাহাকে বলিল, “বাছা ! তুমি আমার জন্য কেন তুঃখ পাইবে ? আমি সন্ন্যাসিনী, আমার কিছুতেই সুখ দুঃখ নাই ; বেতে আমার কি হইবে ? অার বিবস্ত্র —সন্ন্যাসীর পক্ষে সবস্ত্র বিবস্ত্র সমান। কেন দুঃখ পাও—বেত তোল।” - চণ্ডাল বেত উঠাইল না। জয়ন্তী তখন চণ্ডালকে বলিল, “বাছা ! স্ত্রীলোকের কথা বলিয়। বিশ্বাস করিলে না—এই তার প্রমাণ দেখ ” এই বলিয়া জয়ন্তী আপনি বেত উঠাইয়া লইয়া, দক্ষিণ হস্তে দৃঢ়মুষ্টিতে তাহ ধরিল। পরে সেই জনসমারোহ সমক্ষে, আপনার প্রফুল্লপদ্মসন্নিভ রক্তপ্রভ ক্ষুদ্র করপল্লব পাতিয়া, সবলে তাহাতে বেত্ৰাঘাত করিল। বেত, মাংস কাটিয়া লইয়া উঠিল—হাতে রক্তের স্রোত বহিল। জয়ন্তীর গৈরিক বস্ত্র এবং মঞ্চতল তাহাতে প্লাবিত হইল । দেখিয়া লোকে হাহাকার করিতে লাগিল । জয়ন্তী মৃদু হাসিয়া চণ্ডালকে বলিল, “দেখিলে বাছা ! সন্ন্যাসিনীকে কি লাগে ? তোমার ভয় কি ?” চণ্ডাল একবার রুধিরাক্ত ক্ষতপানে চাহিল—একবার জয়ন্তীর সহাস্য প্রফুল্ল মুখপানে চাহিয়া দেখিল—দেখিয়া পশ্চাৎ ফিরিয়া, অতি ত্রস্তভাবে মঞ্চসোপান অবরোহণ করিয়া, উৰ্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করিল। লোকারণ্যমধ্যে সে কোথায় লুকাইল, কেহ দেখিতে পাইল না । রাজা তখন অনুচরবর্গকে আজ্ঞা করিলেন, “দোসর লোক লইয়া আইস— মুসলমান।” অনুচরবর্গ, কালান্তক যমের সদৃশ এক জন কসাইকে লইয়া আসিল । সে মহম্মদপুরে গোরু কাটিতে পারিত না—কিন্তু নগরপ্রান্তে বক্রি মেড়া কাটিয়া বেচিত। সে ব্যক্তি অতিশয় বলবান ও কদাকার । সে রাজাজ্ঞা পাইয়া মঞ্চের উপর উঠিয়া, বেত হাতে লইয়া জয়ন্তীর সম্মুখে দাড়াইল । বেত উচু করিয়া, কসাই জয়ন্তীকে বলিল, “কাপ্ড়। উতার— তেরি গোশ্বত টুকরা টুকরা করকে হাম দোকান্মে বেচেঙ্গে ।” জয়ন্তী তখন অপরিমান মুখে, জনসমারোহকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “রাজাজ্ঞায় এই মঞ্চের উপর বিবস্ত্র হইব । তোমাদের মধ্যে যে সতীপুত্র হইবে, সেই আপনার মাতাকে স্মরণ করিয়া ক্ষণকালের জন্য এখন চক্ষু আবৃত করুক। যাহার কন্যা আছে, সেই আপনার
পাতা:সীতারাম- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/১৪১
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।