পাতা:সীতারাম- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/১৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

তৃতীয় খণ্ড–একবিংশতিতম পরিচ্ছেদ S8S আসিয়া তুর্গ ঘেরিয়াছে।” সীতারাম মনে মনে বলিলেন, “তবে আজ শেষ। ভোগবিলাসের শেষ ; রাজ্যের শেষ ; জীবনের শেষ ।” তখন রাজা রমণীমণ্ডল পরিত্যাগ করিয়া গাত্রোথান করিলেন। বিলাসিনীরা বলিল, “মহারাজ, কোথা যান ? আমাদের ফেলিয়া কোথা যান ?” সীতারাম চোপদারকে আজ্ঞা করিলেন, “ইহাদের বেত মারিয়া তাড়াইয়া দাও।” স্ত্রীলোকের খিল খিল করিয়া হাসিয়া হরিবোল দিয়া উঠিল। তাহাদিগের থামাইয়া ভানুমতী নামে তাহাদিগের মধ্যস্থ এক সুন্দরী রাজার সম্মুখীন হইয়া বলিল, “মহারাজ ! আজি জানিলে বোধ হয় যে, সত্যই ধৰ্ম্ম আছে। আমরা কুলকন্যা, আমাদের কুলনাশ, ধৰ্ম্মনাশ করিয়াছ, মনে করিয়াছ কি, তার প্রতিফল নাই ? আমাদের কাহারও মা কঁাদিতেছে, কাহারও বাপ কঁাদিতেছে, কাহারও স্বামী কাদিতেছে, কাহারও শিশু সন্তান কাদিতেছে—মনে করিয়াছিলে কি, সে কান্না জগদীশ্বর শুনিতে পান না ? মহারাজ, নগরে না, বনে যাও, লোকালয়ে আর মুখ দেখাইও না ; কিন্তু মনে রাখিও যে, ধৰ্ম্ম আছে।” রাজা এ কথার উত্তর না করিয়া, ঘোড়ায় চড়িয়া বায়ুবেগে অশ্ব সঞ্চালিত করিয়া তুর্গদ্বারে চলিলেন। যুবতীগণ পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিল। কেহ বলিল, “আয় ভাই, রাজার রাজধানী লুঠি গিয়া চল। সীতারাম রায়ের সর্বনাশ দেখি গিয়া চল ।” কেহ বলিল, “সীতারাম আল্লা ভজিবে, আমরা সঙ্গে সঙ্গে ভজি গে চল ।” সে সকল কথা রাজার কাণে গেল না। ভানুমতীর কথায় রাজার কাণ ভরিয়াছিল। রাজা এখন স্বীকার করিলেন, “ধৰ্ম্ম আছে ।” রাজা গিয়া দেখিলেন, মুসলমান সেন এখনও গড় ঘেরে নাই—সবে আসিতেছে মাত্র—তাহাদের অগ্রবর্তী ধূলি, পতাকা ও অশ্বারোহী সকল নানা দিকে ধাবমান হইয়া আপন আপন নির্দিষ্ট স্থান গ্রহণ করিতেছে ; এবং প্রধানাংশ দুর্গদ্বার সম্মুখে আসিতেছে। সীতারাম দুর্গমধ্যে প্রবেশ করিয়া দ্বার রুদ্ধ করিলেন। তখন রাজা চারি দিকে পরিভ্রমণ করিতে লাগিলেন। দেখিলেন, প্রায় সিপাহী নাই । বলা বাহুল্য যে, তাহারা অনেক দিন বেতন না পাইয়া ইতিপূর্বেই পলায়ন করিয়াছিল। যে কয় জন বাকি ছিল, তাহারা মৃণায়ের মৃত্যু ও মুসলমানের আগমনবার্তা শুনিয়া সরিয়া পড়িয়াছে। তবে দুই চারি জন ব্রাহ্মণ বা রাজপুত অত্যন্ত প্রভুভক্ত, একবার মুন খাইলে আর ভুলিতে পারে না, তাহারাই আছে। গণিয়া গাথিয় তাহারা জোর পঞ্চাশ জন হইবে। রাজা মনে মনে কহিলেন, “অনেক পাপ করিয়াছি । ইহাদের প্রাণ দান করিব । ধৰ্ম্ম আছে।”