তৃতীয় খণ্ড—ত্রয়োবিংশতিতম পরিচ্ছেদ Ꮌ8Ꮌ তখন সীতারাম আর কিছু না বলিয়া, “জয় জগদীশ্বর ! জয় লছমীনারায়ণজী।” বলিয়া দ্বারাভিমুখে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। সেই ক্ষুদ্র সূচীৰ্বাহ তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিল। তখন সেই সন্ন্যাসিনীরা অবলীলাক্রমে তাহার অশ্বের সম্মুখে আসিয়া ত্রিশূলদ্বয় উন্নত করিয়া— জয় শিব শঙ্কর । ত্রিপুরনিধনকর! , রণে ভয়ঙ্কর! জয় জয় রে! চক্ৰগদাধর । কৃষ্ণ পীতাম্বর ! জয় জয় হরি হর । জয় জয় রে! - - - ইত্যাকার জয়ধ্বনি করিতে করিতে অগ্রে অগ্ৰে চলিল। সবিস্ময়ে রাজা বলিলেন, “সে কি ? এখনই পিশিয়া মরিবে যে ” শ্ৰী বলিল, “মহারাজ ! রাজাদিগের অপেক্ষা সন্ন্যাসীদিগের মরণে ভয় কি বেশী ?” কিন্তু জয়ন্তী কিছু বলিল না। জয়ন্তী আর দপ করে না। রাজাও, এই স্ত্রীলোকের কথার বাধ্য নহে বুঝিয়া আর কিছু বলিলেন না। তার পর দুর্গদ্বারে উপস্থিত হইয়। রাজা স্বহস্তে তাহার চাবি খুলিয়া অর্গল মোচন করিলেন। লোহার শিকল সকলে মহা ঝঞ্চনা বাজিল—সিংহদ্বারের উচ্চ গুম্বুজের ভিতরে, তাহার ঘোরতর প্রতিধ্বনি হইতে লাগিল—সেই অশ্বগণের পদধ্বনিও প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। তখন যবনসেনাসাগরের তরঙ্গাভিঘাতে সেই দুশ্চালনীয় লৌহনিৰ্ম্মিত বৃহৎ কবাট আপনি উদঘাটিত হইল—উন্মুক্ত দ্বীপপথ দেখিয়া সূচীবৃহস্থিত রণবাজিগণ নৃত্য করিতে লাগিল । - এদিকে যেমন বাধ ভাঙ্গিলে বন্যার জল, পাৰ্ব্বত্য জলপ্রপাতের মত ভীষণ বেগে প্রবাহিত হয়, মুসলমান সেনা দুর্গদ্বার মুক্ত পাইয়া তেমনই বেগে ছুটিল। কিন্তু সম্মুখেই জয়ন্তী ও স্ত্রীকে দেখিয়া সেই সেনা-তরঙ্গ,—সহসা মন্ত্রমুগ্ধ ভুজঙ্গের মত যেন নিশ্চল হইল। যেমন বিশ্বমোহিনী দেবীমূৰ্ত্তি, তেমনই অদ্ভুত বেশ, তেমনই অদ্ভুত, অশ্রুতপূৰ্ব্ব সাহস, তেমনই সৰ্ব্বজনমনোমুগ্ধকারী সেই জয়গীতি –মুসলমান সেনা তাহাদিগকে পুররক্ষাকারিণী দেবী মনে করিয়া সভয়ে পথ ছাড়িয়া দিল। তাহারা ত্রিশুল-ফলকের দ্বারা পথ পরিষ্কার করিয়া, যবন সেনা ভেদ করিয়া চলিল। সেই ত্রিশূলমুক্ত পথে সীতারামের সূচীৰ্বাহ অবলীলাক্রমে মুসলমান সেনা ভেদ করিয়া চলিল। এখন সীতারামের অন্তঃকরণে জগদীশ্বর ভিন্ন আর কেহ নাই। এখন কেবল ইচ্ছা, জগদীশ্বর স্মরণ করিয়া তাহার নিদেশবৰ্ত্তী হইয়া মরিবেন।
পাতা:সীতারাম- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/১৫৭
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।