শয়ন করিয়া উপন্যাস শ্রবণ করিতেছিল, তাহারা তাহার অকালে সমাপন দেখিয়া ঘোরতর অসূয়াসূচক সমালোচনার অবতারণা করিল। উদ্ভিদ্-কর্ত্তন-পরাযণা সুন্দরীগণ অস্পষ্টালোকে স্ব স্ব কার্য্য নির্ব্বাহ করিতেছিলেন, তথাপি অবগুণ্ঠন দীর্ঘীকৃত করিলেন। যে মেয়ের বাটনা বাটিতেছিল, তাহারা বড় গোলে পড়িল। এত ঠক্ ঠক্ করিয়া শব্দই বা করি কি করে? আর কাজ বন্ধ করিলেই বা কি মনে করিবেন? আর যাহারা দুগ্ধকটাহের তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত ছিল, তাহারা আরও গোলে পড়িল। তাহারা হঠাৎ একটু অন্তমনস্ক হওয়ায় সব দুধটুকু উছলিয়া পড়িয়া গেল।
সীতারাম বললেন, “তোমরা কেউ গঙ্গাস্নানে যাবে গা?” অমনি “বাবা আমি যাব,” “দাদা আমি যাব,” “জ্যাঠা আমি যাব,” “মামা আমি যাব,” ইত্যাদি শব্দ নানা দিক্ হইতে উখিত হইতে লাগিল। বৃদ্ধা, অর্দ্ধবয়স্কা, প্রৌঢ়া, যুবতী, কিশোরী, বালিকা, পোগণ্ড এবং অপোগণ্ড শিশু, সকলেই এক স্বরে বলিল, “আমি যাব।” অকর্ত্তিত মংস্য অরক্ষিত হইয়া কুকুর এবং বিড়ালের মনোহরণ করিতে লাগিল। যত্ন-প্রস্তুত এবং কর্ত্তিত অলাবু এবং বার্ত্তাকুরাশি রোমন্থশালিনী গাভী জিহ্বা প্রসারণ পূর্বক উদরসাৎ করিতে লাগিল, কেহ দেখিল না। কাহারও দুধ আঁকিয়া গেল, কেহ শিল নোড়া বাঁধিয়া পড়িয়া গেল। কাহারও ছেলে কাঁদিয়া বড় গণ্ডগোল বাধাইল, কিন্তু কিছুতেই কাহারও দৃক্পাত নাই।
সীতারাম বলিলেন, “তবে সকলেই চল। কিন্তু আর সময় নাই, আজ রাত্রে দিন ভাল, খাওয়া দাওয়ার পর সকলকেই যাত্রা করিতে হইবে। অতএব এই বেলা উদ্যোগ কর।”
তৎপরে সীতারাম যথাকালে গৃহিণীর নিকট দেখা দিলেন। গৃহিণী বলিলে একটু দোষ পড়ে। কেন না, গৃহিণী শব্দ এক বচন। এদিকে গৃহিণী, দুইটি। তবে বাঙ্গালায় দ্বিবচন নাই; আর একবারেও দুই গৃহিণীর সাক্ষাৎ হইতে পারে না। এই জন্য বৈয়াকরণদিগের নিকট করযোড়ে মার্জ্জনা প্রার্থনা করিয়া আমরা গৃহিণী শব্দই প্রয়োগ করিলাম।
গৃহিণী দুইটি বলিয়া লোকে নাম রাখিয়াছিল, সত্যভামা আর রুক্মিণী। সত্যভামা এবং রুক্মিণীর চরিত্রের সঙ্গে তাহাদের চরিত্রের যে কোন সাদশ্য ছিল, এমন আমরা অবগত নহি। তাহাদিগের প্রকৃত নাম নন্দা ও রমা। যাঁহার কাছে এখন সীতারাম আসিলেন, তিনি নন্দা। লোকে বলিত সত্যভামা।
নন্দ অন্তরাল হইতে সব শুনিয়াছিল। সীতারামকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “হঠাৎ গঙ্গাস্নানের এত ঘটা কেন?” -
সীতারাম বলিলেন, “গঙ্গে গঙ্গেতি যে ব্রৃঁয়াৎ—”
নন্দা। তা জানি; তিনি মাথায় থাকুন। হঠাৎ তাঁর উপর এ ভক্তি কেন?
সীতা। দেখ, তোমাদের ঐহিক সুখের জন্য আমার যেমন জবাবদিহি, তোমাদের পরকালের সুখের জন্যও আমার তেমনি জবাবদিহি। সামনে একটি যোগ আছে, তোমাদের গঙ্গাস্নানে পাঠাব না?
নন্দয়া। তুমি যখন কাছে আছ, তখন আবার আমাদের গঙ্গাস্নান কি? তুমিই আমাদের সকল তীর্থ। তোমার পাদোদক খাইলেই আমার এক শ গঙ্গাস্নানের ফল হইবে। আমি যাব না।
সীতা। (সত্যভামার নিকট হার মানিয়া) তা তুমি না যাও না যাবে, যারা যেতে চায়, তারা যাক্।