পাতা:সীতারাম- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/১৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পাঠভেদ
১৫৯

 নন্দা। তা যাক্। সবাই যাক্, আমি একা থাকিব, একটু ভূতের ভয় করিবে, তা কি করিব? কিন্তু আসল কথা কি, বল দেখি?

 সীতা। আসল আর নকল কিছু আছে না কি?

 নন্দা। তুমি ত ভাজ পটল, বল উচ্ছে।

 সীতা। তবু ভাল, উচ্ছে ভেজে ত পটল বলি না?

 নন্দা। তা বল না, কিন্তু আমাদের কাছে দুই সমান; লুকোচুরিতেই প্রাণ যায়। ভিতরের কথা কি বলিবে?

 সীতা। বলিবার হইত ত বলিতাম।

 অমনি নন্দার মুখখানা মেঘঢাকা মেঘঢাকা আকাশের মত, জলভরা জলভরা ফোটা পদ্মটার মত, হাই দিলে আরসি যেমন হয়, সেই মত এক রকম কি হইয়া গেল। একটু ধরা ধরা ভরা ভরা আওয়াজে নন্দা বলিল, “তা নাই বলিলে, তা সন্ধ্যার পর তোমার কাছে কে এসেছিল, সেইটা বল?

 সীতা। তা ঢের লোক ত আমার কাছে আসে। সন্ধ্যার পর অনেক লোক এয়েছিল।

 নন্দা। মেয়েমানুষ কে এয়েছিল?

 সীতা। তাও ত ঢের আসে। খাজনা মিটাতে, ভিক্ষা মাঙ্গ্তে‌, দায়ে অদায়ে পড়িয়া ঢের মাগী ত আমার কাছে আসে। স্ত্রীলোক প্রায় সন্ধ্যার পরই আসে।

 নন্দা। আজ সন্ধ্যার পর কজন স্ত্রীলোক এয়েছিল?

 সীতা। মোটে এক জন।

 নন্দা। সে কে?

 সীতা। তার ভাই বাঁচে না।

 নন্দা। তা নয়—সে কে? নাম কি?

 সীতা। আর এক দিন বলিব।

 এইবার মেঘ বর্ষিল, দর্পণস্থ বাষ্পরাশি জলবিন্দুতে পরিণত হইল,—সত্যভামা কাঁদিল।

 তখন সীতারাম নন্দার চিবুক গ্রহণ পূর্ব্বক বড় মধুর আদর করিয়া সেখান হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন।

 যেখানে রমা ঠাকুরাণী দর্পণ লইয়া সরু সরু কালোকুচ্কু‌চে চুলের দড়িগুলি গুচাইতেছিলেন, সেইখানে গিয়া সীতারাম দর্শন দিলেন। রমা কনিষ্ঠা,—নন্দার অপেক্ষা একে বয়সে ছোট, আবার আকারেও ছোট, সুতরাং নন্দার অপেক্ষা অনেক ছোট দেখাইত। নন্দার যৌবন এবং রূপ উভয়ই পরিপূর্ণ, শ্রাবণের গঙ্গা,—রমার দুইই অপরিপূর্ণ, বসন্তনিকুঞ্জপ্রহ্লাদিনী ক্ষুদ্রা কল্লোলিনী। নন্দা তপ্তকাঞ্চনবৎ শ্যামাঙ্গ———রমা হিমানীপ্রতিফলিত কৌমুদীবতৎ গৌরাঙ্গী। সেইখানে গিয়া সীতারাম দর্শন দিলেন। বলিলেন, “রুক্মিণি! গঙ্গাস্নানের কথা শুনেছ?” রমা। ছি ছি, ও কি কথা! সীতা। কোন্‌টা ছি ছি? গঙ্গাস্নান ছি ছি? না রুক্মিণী ছি ছি?