এই সকল বন্দোবস্ত করিতে আবার প্রহর বাজিল। “দগড়া নগড়া গড়াগড়ি” বলিয়া দামামা কি বলিতে লাগিল। তার সঙ্গে মধুর বেহাগ রাগিণী যামিনীকে গভীরা, মূর্ত্তিমতী, ভয়ঙ্করী করিয়া তুলিল। তখন সীতারাম বুঝিলেন, উত্তম সময়, পাহারার সিপাহী ভিন্ন অন্য সিপাহী সকল ঘুমাইয়াছে— কর্ত্তৃপক্ষেরা নিদ্রিত। তখন সীতারাম দ্বারের সমীপস্থ তিন জনকে বলিলেন, “তোমরা তিন জন প্রথমে দ্বারে লাথি মার। গায়ে যত জোর আছে, তত জোরে তিন বার মাত্র লাথি মারিবে। তার পর পিছে সরিয়া দাঁড়াইবে। কিন্তু দেখিও, তিন খানা পা, যেন একেবারেই কপাটের উপর পড়ে; অগ্র পশ্চাৎ হইলে সকল বৃথা। একেবারে তিন জন লাথি মারিবার স্থান এ কপাটে আছে—তাই মাপ করিয়া তিন তিন জন করিয়া সাজাইয়াছি। মুখে বলিও—লছমী নারায়েণকি জয়!”
বন্দীরা বুঝিল। “লছমী-নারায়েণকি জয়!” বলিয়া, তিন জনে ঠিক এক তালে, প্রাণপণ শক্তিতে, সেই লোহার কপাটে পদাঘাত করিল।
বাহিরে চারি জন সিপাহী পাহারায় ঢুলিতেছিল, বজ্রের মত শব্দ সহসা তাহাদের কর্ণে প্রবেশ করাতে তাহারা চমকিয়া উঠিল। কোথায় কিসের শব্দ তাহা বুঝিতে না পারিয়া, এদিক্ ওদিক্ চাহিতে লাগিল।
এ দিকে প্রথম তিন জন সরিয়া পিছনে গিয়াছে; আর তিন জন আসিয়া পলক মধ্যে তাহাদের স্থান লইয়া সেই এক তালে তিন বার কপাটে পদাঘাত করিল। লোহার কপাটের তাহাতে কি হইবে? কিন্তু বড় ঝঞ্চনা বাজিতে লাগিল। এক জন সিপাহী বলিল, “কিয়া রে?”
কিন্তু ভিতর হইতে “লছমী-নারায়েণকি জয়!” ভিন্ন অন্য কোন উত্তর হইল না। দ্বিতীয় সিপাহী বলিল, “শালা লোগ কেওয়াড়ি তোড়নে মাঙ্গ্তা হৈ।”
তৃতীয় সিপাহী। আরে তোড়্নে দেও। বাঙ্গালী লোহেকি কেওয়াড়ি তোড়েগা!
চতুর্থ সিপাহী। কেওয়াড়ি খোল্কে দো চার থাপ্পড় লাগা দেঙ্গে?
প্রথম সিপাহী। আরে যানে দেও। আপহিসে বহ লোগ ঠণ্ডা হো যায়েগা।
এ সকল কথা বন্দীরাও বড় শুনিতে পাইল না। কেন না এখন, বড় ঝড়ের সময়ে যেমন বজ্রাঘাত থামে না, তাহার যেমন উপর্য্যুপরি শব্দ থামে না, সেইরূপ শব্দে এখন লোহার কপাটের উপর পদাঘাত বৃষ্টি হইতেছিল—আর কিছুই শোনা যায় না। কয়েদীরা মাতিয়া উঠিয়াছিল—কিন্তু সীতারাম তাহাদিগকে ধৈর্য্যবিশিষ্ট করিয়া, যাহার যে নির্দ্দিষ্ট স্থান, তাহাকে সেইখানে স্থির রাখিতে লাগিলেন। ফাটকের ভিতর কিছুমাত্র গোলযোগ বা বিশৃঙ্খলা ছিল না।
সিপাহীরা প্রথমে রঙ্গ দেখিতেছিল। মনে করিতেছিল যে, কয়েদীরা কৌতুক করিতেছে, এখনই নিবৃত্ত হইবে। ক্রমে দেখিল যে, সে গতিক নহে—ক্রমে কয়েদীদিগের বল বাড়িতে লাগিল। তখন তাহারা কয়েদীদিগকে শাসিত করা নিতান্তই প্রয়োজন বোধ করিল। তিন জনে পরামর্শ এই করিল যে, তাহারা কপাট খুলিয়া ভিতরে প্রবেশ করিয়া, কয়েদীদিগকে ভাল রকম প্রহার করিয়া নিরস্ত করিবে।
তিন জনের মত হইল, কিন্তু এক জনের হইল না। আলিয়ার খাঁ সকলের প্রাচীন—দাড়ি একেবারে শণের মত। সে বলিল, “বাবা! যদি সত্য সত্যই কয়েদী ক্ষেপিয়া থাকে, তবে আমরা চারি জনে কি