পাতা:সীতারাম- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/১৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৭৪
সীতারাম

তাহাদের থামাইতে পারিব? বরং দ্বার খোলা পাইলে, তাহারা আমাদের চারি জনকে পিষিয়া ফেলিয়া পিল পিল করিয়া পলাইয়া যাইবে। তখন আমরা কি করিব? বরং জমাদ্দারকে খবর দেওয়া যাক্।”

 দ্বিতীয় সিপাহী। কেন জমাদ্দারকে খবর দিবারই তবে প্রয়োজন কি? সত্য সত্য উহার কপাট ভাঙ্গিতে পারিবে, সে শঙ্কা ত আর করিতেছি না। তবে বড় দিক করিতেছে—তার জন্য জমাদ্দারকে দিক করিয়া কি হইবে? আজ থাক, কাল প্রাতে উহাদিগের উচিত সাজা হইবে।

 কিছুক্ষণ সিপাহীরা এই মতাবলম্বী হইয়া নিরস্ত হইল। কয়েদীদিগের দ্বার ভঙ্গের উদ্যম দেখিয়া নানাবিধ হাস্য পরিহাস করিতে লাগিল। বলিতে লাগিল, “বাঙ্গালী লোহার কপাট ভাঙ্গিবে, আর বানরে সঙ্গীত গায়িবে, সমান কথা।”

 লোহা সহজে ভাঙ্গে না বটে, কিন্তু দেয়াল ফাটিতে পারে। লোহার চৌকাট দেয়ালের ভিতর গাথা ছিল। দুই চারি দণ্ড পরে আলিয়ার খাঁ জ্যোৎস্নার আলোকে সভয়ে দেখিল, অবিরত সবল পদাঘাতের তাড়নে দেয়াল ফাটিয়া উঠিয়াছে। তখন সে বলিল, “আর দেখ কি? জমাদ্দারজিকে সম্বাদ দাও। এইবার কপাট পড়িবে।”

 এক জন সিপাহী জমাদারকে খবর দিতে শীঘ্র গেল। আর তিন জন হা করিয়া কপাট পানে চাহিয়া রহিল।

 দেখিল, ক্রমে দেয়াল বেশী বেশী ফাটিতে লাগিল। তার পর, দেয়ালটা ফাপিয়া উঠিল—ভিতরে চৌকাট ঢক্‌ ঢক্‌ করিয়া নড়িতে লাগিল— ঝন্ ঝন্ শব্দ বড় বাড়িয়া উঠিল। লাথির জোর আরও বাড়িতে লাগিল—বজ্রাঘাতের উপর বজ্রাঘাতের মত শব্দ হইতে লাগিল—শেষ, চতুর্দ্দিক্ প্রতিধ্বনিত করিয়া সেই লোহার কপাট, চৌকাট সমেত, দেয়াল ভাঙ্গিয়া মাটিতে পড়িয়া গেল। লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর জয় শব্দে গগন বিদীর্ণ হইল।

 নির্ব্বোধ হিন্দুস্থানীরা, হাঁ করিয়া দাঁড়াইয়া দেখিতেছিল, সরিয়া দাঁড়াইতে ভুলিয়া গিয়াছিল। যখন কপাট পড়িতেছে দেখিল, তখন দৌড়াইয়া পলাইতে লাগিল। দুই জন বাঁচিল, কিন্তু এক জনের পায়ে উপর কপাট পড়ায় সে ভগ্নপদ হইয়া ভূতলে পড়িয়া গেল। এ দিকে কপাট পড়িবামাত্র ভিতর হইতে, বাঁধ ভাঙ্গিলে জলপ্রবাহের মত বন্দি-স্রোত পতিত কপাটের উপর দিয়া হরিধ্বনি করিতে করিতে পতিত প্রহরীকে পদতলে পিষিয়া, গভীর গর্জনে ছুটিল। সর্ব্বাগ্রে সীতারাম বাহির হইয়া আহত প্রহরীর ঢাল সড়্ কী কী তরবারি কাড়িয়া লইয়া আর দুই জনকে যমদূতের ন্যায় আক্রমণ করিলেন। তাঁহার তখনকার ভীষণ মূর্ত্তি দেখিয়া ও তাঁহার দারুণ প্রহারে আহত হইয়া প্রহরিদ্বয় উর্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করিল। জমাদ্দার সাহেব তখনও আসিয়া পৌঁছেন নাই।

 বন্দীগণ হরিধ্বনি করিতে করিতে ছুটিতে লাগিল—সীতারাম অসি হস্তে স্থির হইয়া এক স্থানে দাঁড়াইয়া তাহাদিগের পৃষ্ঠ রক্ষা করিতে লাগিলেন। সকলেই বাহির হইয়া গেলে, সীতারাম আবার একবার কারাগারের ভিতর প্রবেশ করিলেন। তাঁহার স্মরণ হইল যে, এক কোণে এক জন বন্দীকে মুড়ি দিয়া পড়িয়া থাকিতে দেখিয়াছিলেন। সে একবারও উঠে নাই বা কোন সাড়া দেয় নাই। সীতারাম