পাতা:সীতারাম- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/১৮৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পাঠভেদ
১৭৭

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

 শ্যামপুরে সীতারাম একটু স্থির হইলে, লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর দর্শনে সস্ত্রীক হইয়া চলিলেন।

 লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর মন্দির নিকটস্থ এক জঙ্গলে ভূমিমধ্যে প্রোথিত ছিল। সীতারামের আজ্ঞাক্রমে ভূমি খননপূর্ব্বক, তাহার পুনর্বিকাশ সম্পন্ন হইয়াছিল। তন্মধ্যে প্রাচীন দেবদেবীমূর্ত্তি পাওয়া গিয়াছিল। অন্য প্রথম সীতারাম তদ্দর্শনে চলিলেন। সঙ্গে শিবিকারোহণে নন্দা ও রমা চলিলেন।

 যে জঙ্গলের ভিতর মন্দির, তাহার সীমাদেশে উপস্থিত হইয়া তিন জনেই শিবিকা হইতে অবতরণ করিলেন, এবং এক জন মাত্র পথপ্রদর্শক সঙ্গে লইয়া তিন জনে জঙ্গলমধ্যে পদব্রজে প্রবেশ করিলেন। কাননের অপূর্ব্ব শোভা নিরীক্ষণ করিয়া তাঁহাদিগের চিত্ত প্রফুল্ল হইল। অতিশয় শ্যামলোজ্জল পত্ররাশিমধ্যে স্তবকে স্তবকে পুষ্প সকল প্রস্ফুটিত হইয়া রহিয়াছে। শ্বেত হরিং কপিল পিঙ্গল রক্তনীল প্রভৃতি নানা বর্ণের ফুল স্তরে স্তরে ফুটিয়া গন্ধে চারি দিক্ আমোদিত করিতেছে। তন্মধ্যে নানা বর্ণের পাখী সকল বসিয়া নানাস্বরে কৃজন করিতেছে। পথ অতি সঙ্কীর্ণ। গাছের ডালপালা ঠেলিতে হয়, কখন কাঁটায় নন্দারমার আঁচল বাঁধিয়া যায়, কখন ফুলের গোছা তাহাদিগের মুখে ঠেকে, কখন ডাল নাড়া পেয়ে ভোমরা ডাল ছেড়ে তাদের মুখের কাছে উড়িয়া বেড়ায়, কখন তাহাদেব মলের শব্দে ত্রস্তা হইয়া চকিতা হরিণী শয়ন ত্যাগ করিয়া বেগে পলায়ন করে। পাতা খসিয়া পড়ে, ফুল ঝরিয়া যায়, পাখী উড়িয়া যায়, খরা দৌড়িয়া যায়। যথাকালে তাঁহারা মন্দিরসমীপে উপস্থিত হইলেন। তখন তাঁহারা পথপ্রদর্শককে বিদায় দিলেন।

 দেখিলেন, মন্দির ভূগর্ভস্থ, বাহির হইতে কেবল চূড়া দেখা যায়। সীতারামের আজ্ঞাক্রমে মন্দিরদ্বারে অবতরণ করিবার সোপান প্রস্তুত হইয়াছিল; এবং অন্ধকার নিবারণের জন্য দীপ জ্বলিতেছিল। তাহাও সীতারামের আজ্ঞাক্রমে হইয়াছিল। কিন্তু সীতারামের আজ্ঞাক্রমে সেখানে ভৃত্যবর্গ কেহই ছিল না; কেন না, তিনি নির্জ্জনে ভার্য্যাদ্বয়সমভিব্যাহারে দেব দর্শনের ইচ্ছা করিয়াছিলেন।

 সোপান সাহায্যে তাঁহারা তিন জনে মন্দিরদ্বারে অবতরণ করিলে পর, সীতারাম সবিস্ময়ে দেখিলেন যে, মন্দিরদ্বারে দেবমূর্ত্তিসমীপে এক জন মুসলমান বসিয়া আছে। বিস্মিত হইয়া সীতারাম জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে বাবা তুমি?”

 মুসলমান বলিল, “আমি ফকির।”

 সীতারাম। মুসলমান?

 ফকির। মুসলমান বটে।

 সীতা। আ সর্ব্বনাশ!

 ফকির। তুমি এত বড় জমীদার, হঠাৎ তোমার সর্ব্বনাশ কিসে হইল?

 সীতা। ঠাকুরের মন্দিরের ভিতর মুসলমান!

 ফকির। দোষ কি বাবা! ঠাকুর কি তাতে অপবিত্র হইল?

 সীতা। হইল বৈ কি। তোমার এমন দুর্ব্ব দ্ধি কেন হুইল?

২৩