চন্দ্র । এ কি লজ্জার সময় মা ? - শিকড় হইতে হাত দুই উচুতে একটি সরল ডাল ছিল। সে ডালটি উচু হইয়া না উঠিয়, সোজা হইয়া বাহির হইয়া গিয়াছিল। হাতখানিক গিয়া, ঐ ডাল দুই ভাগে বিভক্ত হইয়াছিল। সেই দুই ডালের উপর দুইটি পা দিয়া, নিকটস্থ আর একটি ডাল ধরিয়া দাড়াইবার বড় সুবিধা। চন্দ্রচূড় স্ত্রীকে ইহা দেখাইয়া দিলেন। ঐ লজ্জা ত্যাগ করিয়া উঠিবার চেষ্টা করিল—শ্মশানে লজ্জা থাকে না । প্রথম দুই একবার চেষ্টা করিয়া উঠিতে পারিল না—কাদিতে লাগিল। তার পর, কি কৌশলে কে জানে, শ্ৰী ত জানে না—সে সেই নিম্ন শাখায় উঠিয়া, সেই যোড়া ডালে যুগল চরণ রাখিয়া, আর একটি ডাল ধরিয়া দাড়াইল। তাতে বড় গোলযোগ উপস্থিত হইল। যেখানে ঐ দাড়াইয়াছিল, সেখানে সম্মুখদিকে পাতার আবরণ ছিল না—শ্ৰী সেই অসংখ্য জনতার সম্মুখবৰ্ত্তিনী হইয়া দাড়াইল । সকলে দেখিল, সহসা অতুলনীয় রূপবতী বৃক্ষের ডাল ধরিয়া, শামল পত্ররাশিমধ্যে বিরাজ করিতেছে। প্রতিমার ঠাটের মত, চারি দিকে বৃক্ষশাখা, বৃক্ষপত্র ঘেরিয়া রহিয়াছে; চুলের উপর পাতা পড়িয়াছে, স্থল বাহুর উপর পাতা পড়িয়াছে, বক্ষঃস্থ কেশদাম কতক কতক মাত্র ঢাকিয়া পাতা পড়িয়াছে, একটি ডাল আসিয়া পা দুখানি ঢাকিয়া ফেলিয়াছে, কেহ দেখিতে পাইতেছে না, এ মূৰ্ত্তিমতী বনদেবী কিসের উপর দাড়াইয়াছে। দেখিয়া নিকটস্থ জনত বাত্যাতাড়িত সাগরবৎ, সহসা সংক্ষুব্ধ তুইয়া উঠিল। - শ্ৰী তাহা কিছুই জানিতে পারিল না। আপনার অবস্থান প্রতি তাহার কিছুমাত্র মনোযোগ ছিল না। অনিমেষলোচনে গঙ্গারামের পানে চাহিয়া দেখিতেছিল, দুই চক্ষু দিয়া অবিরল জলধারা পড়িতেছিল। এমন সময়ে শাখাস্তর হইতে চন্দ্রচূড় ড'পিয়া বলিলেন, “এ দিকে দেখ! এ দিকে দেখ! ঘোড়ার উপর কে আসিতেছে ?” ঐ দিগন্তরে দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিল, ঘোড়ার উপর কে আসিতেছে। যোদ্ধবেশ, অথচ নিরস্ত্র। অশ্বী বড় তেজস্বিনী, কিন্তু লোকের ভিড় ঠেলিয়া আগুইতে পারিতেছে না। অশ্বী নাচিতেছে, ফুলিতেছে, গ্রীবা বাকাইতেছে, কিন্তু তবু বড় আগু হইতে পারিতেছে না। ঐ চিনিলেন, অশ্বপৃষ্ঠে সীতারাম। এ দিকে গঙ্গারামকে সিপাহীর কবরে ফেলিতেছিল। সেই সময়ে দুই হাত তুলিয়া সীতারাম নিষেধ করিলেন। সিপাহীরা নিরস্ত হইল। শাহ সাহেব বলিলেন, “কিয়া দেখতে হো ! কাফেরকে মাষ্ট্ৰী দেও।”
পাতা:সীতারাম- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/২২
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।