পাতিয়া, করষোড় করিয়া অতি কাতরস্বরে বলিলেন, “আমার আর নাই। তবে, আর অন্য যা কিছু আছে, তাও দিতেছি। আমার তালুক মুলুক, জমী জেওরাত, বিষয় আশয় সৰ্ব্বস্ব দিতেছি। সব গ্রহণ করুন। উহাকে ছাড়িয়া দিন।” কাজি সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “ও তোমার এমন কে যে, উহার জন্য সৰ্ব্বস্ব দিতেছ?” * সীতা । ও আমার যেই হৌক, আমি উহার প্রাণদানে স্বীকৃত—আমি সৰ্ব্বস্ব দিয়া উহার প্রাণ রাখিব। এই আমাদের হিন্দুর ধৰ্ম্ম । কাজি। হিন্দুধৰ্ম্ম যাহাই হৌক, মুসলমানের ধৰ্ম্ম তাহার বড়। এ ব্যক্তি মুসলমান ফকিরের অপমান করিয়াছে, উহার প্রাণ লইব—তাহাতে সন্দেহ নাই। কাফেরের প্রাণ ভিন্ন ইহার আর অন্য দণ্ড নাই । তখন সীতারাম জামু পাতিয়া কাজি সাহেবের আলখাল্লার প্রান্তভাগ ধরিয়া, বাষ্পগদগদম্বরে বলিতে লাগিলেন, “কাফেরের প্রাণ ? আমিও কাফের। আমার প্রাণ লইলে এ প্রায়শ্চিত্ত হয় না ? আমি এই কবরে নামিতেছি—আমাকে মাটি চাপ৷ দিউন—আমি হরিনাম করিতে করিতে বৈকুণ্ঠে যাইব—আমার প্রাণ লইয়া এই দুঃখীর প্রাণদান করুন। দোহাই তোমার কাজি সাহেব! তোমার যে আল্লা, আমারও সেই বৈকুণ্ঠেশ্বর । ধৰ্ম্মাচরণ করিও । আমি প্রাণ দিতেছি—বিনিময়ে এই ক্ষুদ্র ব্যক্তির প্রাণদান কর।” * কথাটা নিকটস্থ হিন্দু দর্শকেরা শুনিতে পাইয়া হরিধ্বনি দিয়া উঠিল। করতালি দিয়া বলিতে লাগিল, “ধন্য রায়জী ! ধন্ত রায় মহাশয়! জয় কাজি সাহেবক ! গরিবঞ্চে ছাড়িয়া দেও।” যাহার কথা কিছুই শুনিতে পায় নাই, তাহারাও হরিধ্বনি শুনিয়া হরিধ্বনি দিতে লাগিল। তুমুল কোলাহল পড়িয়া গেল। কাজি সাহেবও বিস্মিত হইয়া সীতারামকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ কি বলিতেছেন, রায় মহাশয়! এ আপনার কে যে, ইহার জন্য আপনার প্রাণ দিতে চাহিতেছেন ?” সীতা । এ আমার ভ্রাতার অপেক্ষা, পুত্রের অপেক্ষাও আত্মীয় ; কেন না, আমার শরণাগত। হিন্দুশাস্ত্রের বিধি এই যে, সৰ্ব্বস্ব দিয়া, প্রাণ দিয়া শরণাগতকে রক্ষা করিবে। রাজা ঔশীনর, আপনার শরীরের সকল মাংস কাটিয়া দিয়া একটি পায়রাকে রক্ষা করিয়াছিলেন। অতএব আমাকে গ্রহণ করুন—ইহাকে ছাড়ন ।
পাতা:সীতারাম- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/২৪
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।