প্রথম খণ্ড–চতুর্থ পরিচ্ছেদ >> এই বলিয়া কাজি সাহেব কামারকে হুকুম দিলেন, “ইহারই হাতে পায়ে ঐ হাতকড়ি, বেড়ি লাগাও।” দ্বিতীয় ব্যক্তিকে তিনি ফৌজদারের নিকট পাঠাইলেন— ফৌজদার সাহেব যাহাতে আরও সিপাহী লইয়া স্বয়ং আইসেন, এমন প্রার্থনা জানায়। ফৌজদারের নিকট লোক গেল। কামার আসিয়া সীতারামকে ধরিল। সেই বৃক্ষারূঢ়া বনদেবী শ্ৰী তাহ দেখিল । এদিকে গঙ্গারাম কষ্টে অথচ নির্বিবঘ্নে অশ্ব লইয়া লোকারণ্য হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। কষ্টে—কেন না, আসিতে আসিতে দেখিলেন যে, সেই জনতামধ্যে একটা ভারী গগুগোল উপস্থিত হইল। কোলাহল ভয়ানক হইল, লোকসকল সম্মুখে ছুটিতে লাগিল। র্তাহার অশ্ব এই সকলে অতিশয় ভীত হইয়া দুৰ্দ্দমনীয় হইয়া উঠিল। অশ্বারোহণের কৌশল গঙ্গারাম তেমন জানিতেন না ; ঘোড়া সামলাইতেই তাহাকে এত ব্যতিব্যস্ত হইতে হইল যে, তিনি আর কোন দিকে চাহিয়৷ দেখিতে পারিলেন না যে, কোথায় কি হইতেছে। কেবল “মার ! মার !” একটা শব্দ কাণে গেল। লোকারণ্য হইতে কোন মতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গঙ্গারাম অশ্বকে ছাড়িয়া দিয়া, এক বটবৃক্ষে আরোহণ করিলেন, দেখিবেন—কি হইতেছে। দেখিলেন, ভারী গোলযোগ । সেই মহতী জনতা দুই ভাগে বিভক্ত হইয়াছে। এক দিকে সব মুসলমান—আর এক দিকে সব হিন্দু। মুসলমানদিগের অগ্রভাগে কতকগুলি সিপাহী, হিন্দুদিগের অগ্রভাগে কতকগুলি ঢাল শড়কীওয়ালা । হিন্দুরা বাছা বাছা যোয়ান, আর সংখ্যাতে বেশী। মুসলমানের তাহাদিগের কাছে হঠিতেছে। অনেকে পলাইতেছে। হিন্দুরা “মার মার” শব্দে পশ্চাদ্ধাবিত হইতেছে। এই মার মার শব্দে আকাশ, প্রান্তর, কানন প্রতিধ্বনিত হইতেছিল। যে লড়াই করিতেছে, সেও মার মার শব্দ করিতেছে, যে লড়াই না করিতেছে, সেও মার মার শব্দ করিতেছে। মার মার শব্দে হিন্দুরা চারি দিক্ হইতে চারি দিকে ছুটিতেছে। আবার গঙ্গারাম সবিস্ময়ে শুনিলেন, যাহারা এই মার মার শব্দ করিতেছে, তাহার মধ্যে মধ্যে বলিতেছে, “জয় চণ্ডিকে ! মা চণ্ডী এয়েছেন । চণ্ডীর হুকুম, মার মার! মার! জয় চণ্ডিকে ” গঙ্গারাম ভাবিলেন, “এ কি এ ?” তখন দেখিতে দেখিতে গঙ্গারাম দেখিলেন, মহামহীরুহের শ্বামল-পল্লবরাশি-মণ্ডিত চণ্ডীমূৰ্ত্তি, দুই শাখায় দুই চরণ স্থাপন করিয়া, বাম হস্তে এক কোমল শাখা ধরিয়া, দক্ষিণ হস্তে অঞ্চল ঘুরাইতে ঘুরাইতে ডাকিতেছে, “মার ! মার! শক্র মার!”—অঞ্চল ঘুরিতেছে, অনাবৃত আলুলায়িত কেশদাম বায়ুভরে উড়িতেছে—
পাতা:সীতারাম- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/২৭
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।