৵৹
তত্ত্বের সহজ প্রচারের জন্যই শেষ তিনটি উপন্যাসের আশ্রয় লন। ‘সীতারাম’ —‘আনন্দমঠ’ ও ‘দেবী চৌধুরাণী’রও পরের রচনা; ইহাই তাঁহার শেষ উপন্যাস।
১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর-নবেম্বর মাসে শোভাবাজার রাজবাটীর একটি শ্রাদ্ধ-অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করিয়া পাদ্রি হেস্টি ‘স্টেট্স্ম্যান’ পত্রিকায় হিন্দুধর্ম্মের উপর যে আক্রমণ চালাইয়াছিলেন, “রামচন্দ্র” এই বেনামে তাহার জবাব দিতে গিয়া হিন্দুধর্ম্মের মূল তত্ত্বগুলি সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্রের মনে নানা প্রশ্ন জাগে। ইহা ‘আনন্দমঠ’ প্রকাশের অব্যবহিত পরের ঘটনা। ফলে তৎকালীন প্রসিদ্ধ দার্শনিক পণ্ডিত যোগেন্দ্রচন্দ্র ঘোষকে লিখিত Letters on Hinduism। এই অসম্পূর্ণ পত্রগুলিতে হিন্দুধর্ম্মের মূল তত্ত্বের ব্যাখ্যার একটা প্রয়াস আছে। ইহার পরেই ‘দেবী চৌধুরাণী’—ইহার দ্বিতীয় খণ্ড পর্য্যন্ত প্রকাশ করিয়া ‘বঙ্গদর্শন’ বিলুপ্ত হয়; সম্পূর্ণ পুস্তক প্রকাশিত হয় ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের গোড়াতেই। ঐ সালের জুলাই মাস (শ্রাবণ, ১২৯১) হইতে বঙ্কিমচন্দ্র-পরিচালিত ‘প্রচার’ পত্রিকার আবির্ভাব ঘটে। ঐ শ্রাবণ মাসেই অক্ষয়চন্দ্র সরকার-সম্পাদিত ‘নবজীবন’ও আত্মপ্রকাশ করে। এই দুইটি সাময়িক-পত্রের সহায়তায় বঙ্কিমচন্দ্র হিন্দুধর্ম্ম সম্বন্ধে তাঁহার নূতন ধারণা প্রচার করিতে থাকেন। এই প্রচারে ‘সীতারাম’ অন্যতম “কল” মাত্র। প্রথম সংখ্যা হইতেই ইহা প্রকাশিত হইতে থাকে; ১২৯৩ সালের মাঘ পর্য্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ইহা প্রকাশিত হয়, মধ্যে কয়েক মাস বন্ধ ছিল।
‘প্রচারে’র প্রথম সংখ্যাতেই (শ্রাবণ, ১২৯১) বঙ্কিমচন্দ্র পর পর দুইটি প্রবন্ধ লেখেন—“বাঙ্গালার কলঙ্ক” ও “হিন্দুধর্ম্ম”। এই দুইটি রচনায় ‘সীতারাম’ উপন্যাসের প্রতিপাদ্য তত্ত্ব অতি স্পষ্ট ভাষায় লিখিত আছে। নিম্নে প্রবন্ধ দুইটি হইতে আমাদের প্রয়োজনীয় অংশ উদ্ধৃত করিতেছি।—
...কদাচিৎ অন্যান্য ভারতবাসীর বাহুবলের প্রশংসা শুনা যায়, কিন্তু বাঙ্গালীর বাহুবলের প্রশংসা কেহ কখন শুনে নাই। সকলেরই বিশ্বাস, বাঙ্গালী চিরকাল দুর্ব্বল, চিরকাল ভীরু, চিরকাল স্ত্রীস্বভাব, চিরকাল ঘুসি দেখিলেই পলাইয়া যায়। মেকলে বাঙ্গালীর চরিত্রসম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছেন, এরূপ জাতীয় নিন্দা কখন কোন লেখক কোন জাতি সম্বন্ধে কলমবন্দ করে নাই। ভিন্নদেশীয় মাত্রেরই বিশ্বাস যে, সে সকল কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। ভিন্নজাতীয়ের কথা দূরে থাকুক, অধিকাংশ বাঙ্গালীরও এইরূপ বিশ্বাস। উনবিংশ শতাব্দীর বাঙ্গালীর চরিত্র সমালোচনা করিলে, কথাটা কতকটা যদি সত্য বোধ হয়, তবে বলা যাইতে পারে, বাঙ্গালীর এখন এ দুর্দ্দশা হইবার অনেক কারণ আছে। মানুষকে মারিয়া ফেলিয়া তাহাকে মরা বলিলে