আমি যাহা দেখিয়াছি, তাঁহাই লিখিতেছি। সেই ললিতাগরি আমার চিরকাল মনে । থাকিৰে। চারি দিকে—যোজনের পর যোজন ব্যাপিয়া—হরিদ্বর্ণ ধান্তক্ষেত্র,—মাতা বস্তুমতীর অঙ্গে বহু-যোজন-বিস্তৃতা পীতাম্বী শাটা। তাহার উপর মাতার অলঙ্কার স্বরূপ, তাল বৃক্ষশ্রেণী—সহস্ৰ সহস্ৰ, তার পর সহস্ৰ সহস্র তালবৃক্ষ ; সরল, স্থপত্র, শোভাময়! মধ্যে নীলসলিলা বিরূপ, নীল গীত পুষ্পময় হরিংক্ষেত্র মধ্য দিয়া বহিতেছে—মুকোমল গালিচার উপর কে নদী আঁকিয়া দিয়াছে। তা যাক-চারি পাশে মৃত মহাত্মাদের মহীয়সী কীৰ্ত্তি। পাথর এমন করিয়া যে পালিশ করিয়াছিল, সে কি এই আমাদের মত হিন্দু ! এমন করিয়া বিনা বন্ধনে যে গাঁথিয়াছিল, সে কি আমাদের মত হিন্দু? আর এই প্রস্তর মূৰ্ত্তি সকল যে খোদিয়াছিল—এই দিব্য পুষ্পমাল্যাভরণভূষিত বিকম্পিতচেলাঞ্চলপ্রবুদ্ধসৌন্দৰ্য্য, সৰ্ব্বাঙ্গমুন্দরগঠন, পৌরুষের সহিত লাবণ্যের মূৰ্ত্তিমান সম্মিলনস্বরূপ পুরুষমূৰ্ত্তি, যাহারা গড়িয়াছে, তাহার কি হিন্দু ! এই কোপপ্রেমগৰ্ব্বসৌভাগ্যক্ষুরিতাধরা, চীনাস্বর, তরলিতরত্নহার, পীবরযৌবনভারাবনতদেহা— তন্ত্ৰী শ্ৰাম শিখরদশন পঙ্কবিম্বাধরোষ্ঠী মধ্যে ক্ষমা চকিতহরিণীপ্রেক্ষণা নিয়নাভিঃ— এই সকল স্ত্রীমূৰ্ত্তি যারা গড়িয়াছে, তারা কি হিন্দু ? তখন হিন্দুকে মনে পড়িল। তখন মনে পড়িল, উপনিষদ, গীত, রামায়ণ, মহাভারত, কুমারসম্ভব, শকুন্তলা, পাণিনি, কাত্যায়ন, সাংখ্য, পাতঞ্জল, বেদান্ত, বৈশেষিক, এ সকলই হিন্দুর কীৰ্ত্তি—এ পুতুল কোন ছার। তখন মনে করিলাম, হিন্দুকুলে জন্ম গ্রহণ করিয়া জন্ম সার্থক করিয়াছি। সেই ললিতগিরির পদতলে বিরূপা-তীরে গিরির শরীরমধ্যে, হস্তিগুম্ফা না এক গুহা ছিল। গুহা বলিয়া, আবার ছিল বলিতেছি কেন ? পৰ্ব্বতের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কি আবার লোপ পায় ? কাল বিগুণ হইলে সবই লোপ পায়। গুহাও আর নাই। ছাদ পড়িয়া গিয়াছে, স্তম্ভ সকল ভাঙ্গিয়া গিয়াছে,—তলদেশে ঘাস গজাইতেছে। সৰ্ব্বস্ব লোপ পাইয়াছে, গুহাটার জন্য দুঃখে কাজ কি ? কিন্তু গুহা বড় সুন্দর ছিল। পৰ্ব্বতাঙ্গ হইতে খোদিত স্তম্ভ প্রাকার প্রভৃতি বড় রমণীয় ছিল। চারি দিকে অপূৰ্ব্ব প্রস্তরে খোদিত নরমূৰ্ত্তি সকল শোভা করিত। তাহারই দুই চারিটি আজিও আছে। কিন্তু ছাতা পড়িয়াছে, রঙ্গ জলিয়া গিয়াছে, কাহারও নাক ভাঙ্গিয়াছে, কাহারও হাত ভাঙ্গিয়াছে, কাহারও পা ভাঙ্গিয়াছে। পুতুলগুলাও আধুনিক হিন্দুর মত অঙ্গহীন হইয়া আছে।
পাতা:সীতারাম- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/৪৮
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।