দ্বিতীয় খণ্ড—তৃতীয় পরিচ্ছেদ es সেনাপতি মৃন্ময় রায় আসিয়া চন্দ্রচূড় ঠাকুরকে মন্ত্রণ জিজ্ঞাসা করিলেন। বলিলেন, “এখানে পড়িয়া মার খাইব কেন ? যদি তোরা খা আসিতেছে, তবে সৈন্য লইয়া অৰ্দ্ধেক পথে গিয় তাহাকে মারিয়া আসি না কেন ?” চন্দ্রচূড় বলিলেন, “এই প্রবল নদীর সাহায্য কেন ছাড়িবে ? যদি অৰ্দ্ধপথে তুমি হার, তবে আর আমাদের দাড়াইবার উপায় থাকিবে না ; কিন্তু তুমি যদি এই নদীর এ পারে, কামান সাজাইয়া দাড়াও, কার সাধ্য এ নদী পার হয় ? এ হাটিয়া পার হইবার নদী নয়। সংবাদ রাখ, কোথায় নদী পার হইবে। সেইখানে সৈন্য লইয়া যাও, তাহা হইলে মুসলমান এ পারে আসিতে পারিবে না। সব প্রস্তুত রাখ, কিন্তু আমায় না বলিয়া যাত্রা করিও না।” চন্দ্রচূড় গুপ্তচরের প্রত্যাগমন প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। গুপ্তচর ফিরিলেই তিনি সংবাদ পাইবেন, কখন কোন পথে তোরা খার সৈন্য যাত্রা করিবে ; তখন ব্যবস্থা করিবেন। এ দিকে অন্তঃপুরে সংবাছ পৌছিল যে, তোরা খাঁ সসৈন্তে মহম্মদপুর লুঠিতে আসিতেছে। বহির্বাটার অপেক্ষা অন্তঃপুরে সংবাদটা কিছু বাড়িয়া যাওয়াই রীতি। বাহিরে, “আসিতেছে।” অর্থে বুঝিল, আসিবার উদ্যোগ করিতেছে। ভিতর মহলে, “আসিতেছে’ অর্থে বুঝিল, “প্রায় আসিয়া পৌছিয়াছে।” তখন সে অন্তঃপুর মধ্যে কাদাকাটার ভারি ধূম পড়িয়া গেল। নন্দার বড় কাজ বাড়িয়া গেল—কয়জনকে এক বুঝাইবে, কয়জনকে থামাইবে । বিশেষ রমাকে লইয়াই নন্দাকে বড় ব্যস্ত হইতে হইল— কেন না, রমা ক্ষণে ক্ষণে মূৰ্ছা যাইতে লাগিল। নন্দ মনে মনে ভাবিতে লাগিল, “সতীন মরিয়া গেলেই বাচি–কিন্তু প্রভু যখন আমাকে অন্তঃপুরের ভার দিয়া গিয়াছেন, তখন আমাকে আপনার প্রাণ দিয়াও সতীনকে বাচাইতে হইবে।” তাই নন্দা সকল কাজ ফেলিয়া রমার সেবা করিতে লাগিল । এ দিকে পৌরস্ত্রীগণ নন্দাকে পরামর্শ দিতে লাগিল—“মা ! তুমি এক কাজ কর— সকলের প্রাণ রচিাও। এই পুরী মুসলমানকে বিনা যুদ্ধে সমর্পণ কর—সকলের প্রাণ ভিক্ষা মাঙ্গিয়া লও। আমরা বাঙ্গালী মানুষ, আমাদের লড়াই ঝগড়া কাজ কি মা ! প্রাণ বঁচিলে আবার সব হবে। সকলের প্রাণ তোমার হাতে—ম, তোমার মঙ্গল হোক— আমাদের কথা শোন ।” মন্দা তাহাদিগকে বুঝাইলেন। বলিলেন, “ভয় কি মা ! পুরুষ মানুষের চেয়ে তোমরা কি বেশী বুঝ ? তারা যখন বলিতেছেন ভয় নাই, তখন ভয় কেন ? তাদের কি আপনার প্রাণে দরদ নাই—না আমাদের প্রাণে দরদ নাই ?”
পাতা:সীতারাম- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/৫৯
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।