তৃতীয় খণ্ড—তৃতীয় পরিচ্ছেদ >> গঙ্গারাম দেখিল, ক্রমে গতিক মন্দ হইয়া আসিল । এক ভরসা মনে এই উদয় হইল, মুরলা নিজে কখনও এ সকল কথা প্রকাশ করিবে না—কেন না, তাহ হইলে সেও দণ্ডনীয়—তার কি আপনার প্রাণের ভয় নাই ? তখন গঙ্গারাম বলিল, “মুরলাকে ডাকিয়৷ জিজ্ঞাসা করা হউক—কথা সকলই মিথ্যা প্রকাশ পাইবে।” বেচারা জানিত না যে, মুরলাকে, মহারাজ্ঞী শ্ৰীমতী নন্দ ঠাকুরাগী পূর্বেই হাত করিয়া রাখিয়াছিলেন। নন্দ, মুরল্লাকে বুঝাইয়াছিল যে, “মহারাজা স্ত্রীহত্যা করেন না—তোর মরিবার ভয় নাই। স্ত্রীলোককে শারীরিক কোন রকম সাজা দেন না। অতএব বড় সাজার তোর ভয় নাই। কিছু সাজা তোর হইবেই হইবে। তবে, তুই যদি সত্য কথা বলিস্—তোর সাজা বড় কম হবে।” মুরলাও তাহ বুঝিয়াছিল, সুতরাং সব কথা ঠিক বলিল—কিছুই ছাড়িল না। মুরলার কথা গঙ্গারামের মাথায় বজ্রাঘাতের মত পড়িল । তথাপি সে আশা ছাড়িল না। বলিল, “মহারাজ ! এ স্ত্রীলোক অতি কুচরিত্রা । আমি নগরমধ্যে ইহাকে অনেক বার ধরিয়াছি, এবং কিছু শাসনও করিতে হইয়াছিল। বোধ হয় সেই রাগে এ সকল কথা বলিতেছে।” রাজা । তবে কার কথায় বিশ্বাস করিব, গঙ্গারাম ? খোদ মহারাণীর কথা বিশ্বাসযোগ্য কি ? গঙ্গারাম যেন হাত বাড়াইয়া স্বর্গ পাইল । তাহার নিশ্চিত বিশ্বাস যে, রমা কখনও এ সভামধ্যে আসিবে না বা এ সভায় এ সকল কথা বলিতে পরিবে না । গঙ্গারাম বলিল, “অবশ্ব বিশ্বাসযোগ্য। তার কথায় যদি আমি দোষী হই, আমাকে সমুচিত দণ্ড দিবেন।” রাজা অন্তঃপুর অভিমুখে দৃষ্টি করিলেন। তখন গঙ্গারাম সবিস্ময়ে দেখিল, অতি ধীরে ধীরে সশঙ্কিত শিশুর মত, এক মলিনবেশধারিণী অবগুণ্ঠনবতী রমণী সভামধ্যে আসিতেছে। যে রূপ, গঙ্গারামের হাড়ে হাড়ে আঁকা, তাহ দেখিয়াই চিনিল। গঙ্গারাম বড় শঙ্কিত হইল। দর্শকমণ্ডলীমধ্যে মহা কোলাহল পড়িয়া গেল। শান্তিরক্ষকেরা তাহাদের থামাইল । রম আসিয়া আগে রাজাকে, পরে গুরু চন্দ্রচূড়কে দূর হইতে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া, অবগুণ্ঠন মোচন করিয়া সৰ্ব্বসমক্ষে দাড়াইল—মলিনবেশেও রূপরাশি উছলিয়। পড়িতে লাগিল। চন্দ্রচূড় দেখিল, রাজা কথা কহিতে পারিতেছেন না—অধোবদনে আছেন। তখন চন্দ্রচূড় রমাকে বলিলেন, “মহারাণী ! এই গঙ্গারামের বিচার হইতেছে। এ ব্যক্তি
পাতা:সীতারাম- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/৯৯
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।