সীতারাম সেনাপতি পরাস্ত, বন্দী অথবা নিহত হইতে লাগিলেন, আলিমৰ্দ্দান খাঁ, ইসমাইল খাঁ মকা, কাসিম খাঁ, হিম্মৎ খাঁ, রুহুল্লা খাঁ, রুস্তম খাঁ, আর কত নাম করিব ? বিশেষতঃ ধমাজী যাদব ও শাস্তাঙ্গী ঘোরপড়ে নামক দুই জন অদম্য মারাঠা অশ্বপতি সেনানায়ক মুঘল-সৈন্যদের নাস্তানাবুদ করিয়া দিল। এই দুই জনের এমন খ্যাতি হইল যে, মুঘল-সৈন্যেরা ঘোড়াকে জলাশয়ে লইয়া গেলে পর ঘোড়া যদি ভড়কাইত বা জল পান না করিত, তখন তাহাকে বলিত, “কি রে ! তুই বুঝি জলে ধন্না যাদবের মুখ দেখতে পাচ্ছিস ?” আর, বাদশাহের সর্ব্বোচ্চ সেনানায়ক ফিরোজ জঙ্গ (নিজামবংশের প্রতিষ্ঠাতা ) “যখন শুনিতেন যে, শান্তাজী তাঁহার ৮৭৯ ক্রোশের মধ্যে আসিয়াছে, অমনি তাঁহার মুখ ভয়ে পাণ্ডুবর্ণ হইয়া যাইত, এবং শান্তাকে আক্রমণ করিতে যাইতেছি, এই মিথ্যা ঘোষণা করিয়া দিয়া শিবির তুলিয়া সেখান হইতে অন্য পথ দিয়া দূরে পলাইয়া যাইতেন” ( ডফ ii 406 n., খাফি খাঁ ii 446 ) । উত্তর-ভারতে জাঠশক্তির অভ্যুদয় হইল, তাহারা আগ্রায় ও আগ্রার চারি দিকে লুঠিয়া বেড়াইতে লাগিল, তাহাদের বাধা দিবার কেহ রহিল না। রাজপুতানায় যে এই সময় ত্রিশবর্ষব্যাপী আগুন জ্বলিতে থাকিল, তাহা ‘রাজসিংহে'র ভূমিকায় দেখাইয়াছি । বাদশাহের এই সব নিগ্রহ ও অক্ষমতার সত্য সংবাদ সুদূর প্রান্ত বঙ্গদেশে পৌঁছিতে পৌঁছিতে আরও পল্লবিত হইল। অমনি জমিদারগণ খাজনা দেওয়া বন্ধ করিল, দক্ষিণবঙ্গ ও উড়িষ্যার অসংখ্য ছোট ছোট পাঠানবংশ মাথা খাড়া করিল, সাধারণ ডাকাতেরা দল বাঁধিয়া পথে গ্রামে লুঠিতে লাগিল। শেষে প্রকাশ্য বিদ্রোহ দেখা দিল ; শোভাসিংহ ও রহিম আফগানের বিদ্রোহ—-বৰ্দ্ধমান-চন্দ্রকোনা হইতে রাজমহল পর্য্যন্ত ছড়াইল, ১৬৯৬-১৬৯৮ সন। [ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'স্বপ্নময়ী' নাটক সম্পূর্ণ কাল্পনিক নহে । ] সুদূর দাক্ষিণাত্যে উত্তরভারতের কোন ১৬৯ -১৬৯৭ আট বৎসর এইরূপ বিপ্লব চলিল । তাহার পর ১৬৯৮ সনে নূতন সুবাদার শাহজাদা আজীম-উদ্দীন ঐ বিদ্রোহ দমম করিলেন। রহিম যুদ্ধে হত এবং শোভাসিংহ অপঘাতে মৃত হইল ৷ এবং ১৭০০ সনের শেষে অসাধারণ দক্ষ ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নূতন দেওয়ান মুর্শিদ কুলী খাঁ বাঙ্গলায় পৌঁছিয়া দেশে কতকটা শান্তি ও সুব্যবস্থা স্থাপন করিতে পারিলেন। কিন্তু তাহাতে প্রজাদের কোন লাভ হইল না। অতিবৃদ্ধ বাদশাহ নিজে মারাঠা অক্ষৌহিণী কর্তৃক অনবরত ঘেরা, সুবায় সৈন্য ও কামান পাঠাইয়া সাহায্য করা তাঁহার পক্ষে অসম্ভব ; বরং তিনি এই দশ- বারো বৎসর ক্রমাগত হিন্দুস্থান হইতে নূতন-ভর্ত্তি সৈন্য ও আগ্রার কোষাগার হইতে পূর্ব্বপুরুষদের সঞ্চিত ধনরত্ন চাহিয়া আনাইয়া তাহা প্রায় নিঃশেষ করিয়া দিলেন। সুতরাং বাঙ্গলায় স্থানীয় বিদ্রোহ বেশী বিস্তৃত হইলে তাহা দমন করা সুবাদারের অসাধ্য ছিল। শোভাসিংহ ও রহিম খাঁর পতনের পর বাঙ্গলার কেন্দ্রীয় অংশে শাস্তি স্থাপিত
পাতা:সীতারাম- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৫৫).pdf/১০
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।