পাতা:সীতারাম- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৫৫).pdf/১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঐতিহাসিক ভূমিকা সুতরাং গঙ্গারামের লঘু অপরাধে জীবন্ত সমাধির হুকুম সে যুগের বাঙ্গলার ঐতিহাসিক সত্যের অনুযায়ী; এটি বঙ্কিমের কল্পনা-প্রস্তুত অসম্ভব ঘটনা নহে। এই অবিচারী ধর্ম্মান্ধ সম্রাটের বিরুদ্ধে প্রজাপুঞ্জের স্বাভাবিক ন্যায্য প্রতিক্রিয়া রাজপুত, শিখ, মারাঠা ও জাঠদের মধ্যে যাহা তখন ঘটে, তাহা ভারত-ইতিহাস হইতে সকলেই জানেন। বাঙ্গলায় তাহাই উপন্যাসছলে বঙ্কিম আঁকিয়াছেন । সীতারাম-চরিত্র তবে সীতারামের পতন হইল কেন ? যশোহর-খুলনার ইতিহাসের জন্মভূমিভক্ত গবেষক সতীশচন্দ্র মিত্র স্বীকার করিয়াছেন যে, রাজা হইবার পর সীতারাম বড় বিলাসী ও ইন্দ্রিয়- পরায়ণ হইয়া পড়েন, এরূপ কথা সেই অঞ্চলে এখনও প্রচলিত। রাজা-নবাবরা আরাম ও নেশায় মত্ত থাকিবে, রংমহালে যুবতিশত-বৃতং হইয়া অহোরাত্র লীলা করিবে, এটা আর আশ্চর্য্য কথা কি ? কিন্তু এইখানেই বঙ্কিম তাঁহার কবি-প্রতিভার পরিচয় দিয়াছেন, এই তুচ্ছ নিত্যনৈমিত্তিক ভোগ-বিলাসের অন্তরে একটি গূঢ় কারণ নিহিত করিয়া ইহাকে সাধারণ বাস্তব জগৎ হইতে অনেক দূরে, অনেক উর্দ্ধে আনিয়াছেন । তাঁহার সীতারাম রায় প্রথমে আমাদের কাছে দেখা দেন—অনন্যসামান্য মহাপ্রাণ উদ্যোগী পুরুষসিংহ-রূপে। তাহার পর ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাতে তাঁহার চরিত্রের অভিব্যক্তি হইয়া ক্ৰমে গভীর অবনতিতে আসিয়া পড়েন,—যদিও জীবনের শেষ মুহূর্তে তাঁহার বীরত্ব মনুষ্যত্ব আবার দপ, করিয়া জ্বলিয়া উঠিল ৷ নায়কের এই চরিত্র-পরিবর্ত্তনই ‘সীতারাম' উপন্যাসকে শেক্ষপীয়রের ‘ম্যাকবেথে’র মত শ্রেষ্ঠ বিয়োগান্ত নাটক করিয়া তুলিয়াছে। এই দুই কাব্যেই আমরা দেখি, কেমন করিয়া ধীরে ধীরে, প্রায় অদৃশ্য গতিতে বাহ্য ঘটনার আঘাতে অর্থাৎ স্বাভাবিক কারণে, একজন দেব-চরিত্র বীর অবশেষে দানব হইয়া উঠেন ৷ ‘আনন্দমঠ' ও ‘দেবীচৌধুরাণী’তে চরিত্রের ক্রমবিকাশ উপরের দিকে, ক্রমে মহৎ হইতে মহত্তর হইতেছে, - —যেমন বৌদ্ধ-গল্পে এক একজন বোধিসত্ত্ব মানুষ হইয়া জন্মিলেও ক্রমে আত্মসংযম, স্বার্থত্যাগ এবং সুবুদ্ধির ফলে উচ্চ হইতে উচ্চতর জন্মের ভিতর দিয়া অবশেষে চরম স্তরে পৌঁছিয়া একজন সম্পূর্ণ বুদ্ধ হইয়া নিৰ্ব্বাণ লাভ করেন। সীতারামের হৃদয়ের গতি ঠিক ইহার বিপরীত দিকে। আর একটি উপমা দিই—শেক্ষপীয়রের 'জুলিয়াস সিজার' নাটকের এন্টনি কি বীর দক্ষ কর্মকুশল যোদ্ধা! আর সেই লোকটিই 'এন্টনি এও ক্লিওপ্যাট্রা' নাটকে উদ্যোগহীন ইন্দ্রিয়পরায়ণ কামিনীর দাস হইয়া প্রাণ দিলেন । আমাদের এই উপন্যাসখানির আরম্ভে আমরা সীতারামের পরিচয় পাই—এক অসাধারণ সত্যব্রতী, স্বার্থত্যাগী, পরহিতপরায়ণ, তীক্ষ্ণবুদ্ধি, দ্রুতসিদ্ধান্তে অভ্যস্ত কর্মবীর,