ঐতিহাসিক ভূমিকা বঙ্কিম স্বয়ং বলিয়াছেন, “সীতারাম ঐতিহাসিক ব্যক্তি। এই গ্রন্থে সীতারামের ঐতিহাসিকতা কিছুই রক্ষা করা হয় নাই । গ্রন্থের উদ্দেশ্য ঐতিহাসিকতা নহে” ( ‘সীতারামে'র বিজ্ঞাপন ) । আবার, “দুর্গেশনন্দিনী বা চন্দ্রশেখর বা সীতারামকে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা যাইতে পারে না” ( ‘রাজসিংহে’র বিজ্ঞাপন ) । কিন্তু বঙ্গদেশের সত্য ইতিহাস পড়িবার পর বঙ্কিমের এই অস্বীকার-বাণী গ্রহণ করা যাইতে পারে না। আমরা দেখিতে পাই যে, তাঁহার ‘সীতারাম' উপন্যাস হইলেও প্রকৃতপক্ষে ইহা একখানি ঐতিহাসিক উপন্যাস, এবং তিনি এই গ্রন্থে ঐতিহাসিক উপন্যাসের লক্ষণগুলি 'দুর্গেশনন্দিনী' ও 'চন্দ্রশেখর' হইতে অনেক অধিক পরিমাণে রক্ষা করিয়াছেন; এই গ্রন্থখানি ইউরোপীয় সাহিত্যে রচিত হইলে সেখানকার গুণিগণ ইহাকে ঐতিহাসিক উপন্যাসের শ্রেণীতে নিঃসন্দেহ স্থান দিতেন; তাহার কারণ, পরিষৎ-সংস্করণের 'আনন্দমঠে'র ভূমিকাতে আমি বিস্তারিত বিচার করিয়াছি। অর্থাৎ, বঙ্কিমচন্দ্র সীতারাম নামক রাজার জীবনের ঘটনাগুলির ও সেই যুগের বাঙ্গলার অবস্থার যে বিবরণ দিয়াছেন, তাহা অধিকাংশ একেবারে সত্য ; ইহার কোন স্থানেই ঐতিহাসিক সত্যের প্রচণ্ড অপলাপ করেন নাই ; ইতিহাসে পরিচিত কোন বিখ্যাত সাধুকে উপন্যাসের পাতায় ঠগ বলিয়া অঙ্কিত করিলে যে দূষিত কল্পনা হইত, সীতারামে কোথায়ও তাহা হয় নাই । এর উপর, সেই যুগে প্রজা ও শাসকের সম্বন্ধ, দেশের দশা, যুদ্ধ-বিগ্রহ-প্রণালী বঙ্কিম অক্ষরে অক্ষরে সত্য করিয়া আঁকিয়াছেন, অর্থাৎ এই উপন্যাসখানির দৃশ্যপট একেবারে সত্য। এই দুটি কথা এখানে প্রমাণ করিব । বঙ্কিমের ‘সীতারাম' ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম ছাপা হয়। তাহার পর ইহার ঐতিহাসিক সত্যাসত্যতা লইয়া অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্যান্য কয়েক জন লেখক আলোচনা করিয়াছেন। কিন্তু ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দে সতীশচন্দ্র মিত্রের 'যশোহর-খুলনার ইতিহাস' দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হইবার ফলে ঐ সব পুরাতন তর্কবিতর্কের নিরসন হইয়াছে, এবং সীতারামের প্রকৃত বিবরণ সম্পূর্ণ ও বিস্তৃতভাবে জানা গিয়াছে । সে যুগের পারসী সরকারী কাগজ এবং ফরাসী কুঠিয়াল সাহেবদের চিঠি হইতে ঐ সময়কার দেশের ইতিহাস অতি বিশদ ও বিশুদ্ধ ভাবে জানা যায়। আমি এই দিকেই সতীশচন্দ্রের গ্রন্থের উপর কতকগুলি তথ্য যোগ করিয়া দিব। রাজা সীতারামের কার্য্যকলাপ সম্বন্ধে বেশী কিছু পাই নাই।* সমসাময়িক সাক্ষীর কাহিনী ও স্থানীয় প্রবাদ অবলম্বনে ঐতিহাসিক সীতারামের জীবনী নীচে লিখিত হইল ৷
- ইংরাজদের মাদ্রাজ কুঠীর কার্য্যনির্বাহক-সমিতির কার্য্য-বিবরণ-গ্রন্থ হইতে জানা যায় যে, সেই
হেড অফিসে ভিজাগাপটম হইতে যে পত্রগুলি পৌঁছে, তাহাতে সীতারাম, ‘সম্-বিয়ারেড' ( সুবিয়া রেডতী ? ) ও অন্যান্য সামস্ত রাজাদের সম্রাটের ফৌজদারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হইবার উল্লেখ আছে। ঐ সৰ উল্লেখ উক্ত গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয় ডিসেম্বর ১৬৮৯ ও ১৬৯৪। ইনি আমাদের সীতারাম হইতে পারেন