পাতা:সীতারাম- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৫৫).pdf/৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঐতিহাসিক ভূমিকা দুর্গ রক্ষা করা হইল না, রাজধানীর মধ্যে চারি দিকে ছত্রভঙ্গ আরম্ভ হইল। সীতারামের বহু পরিবারের মধ্যে অনেকেই (তাঁহার কয়েকজন স্ত্রী ও সন্তান) আগেই মহম্মদপুর হইতে বাহিরে পলাইয়া গেলেন, ১৭১৪ সনে তাঁহাদের কয়জন কলিকাতায় ধরা পড়েন । সীতারামের পরাজয়ে শত্রুপক্ষের দক্ষিণ হস্ত ছিলেন রামজীবন আমূলা, বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ, নাটোর-রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা, এবং সীতারামকে বন্দী করিয়া মুর্শিদাবাদে লইয়া যান রামজীবনের ভৃত্য দয়ারাম রায়, দীঘাপতিয়া রাজবংশের আদিপুরুষ। তাঁহার বিশাল রাজ্য ছিন্নভিন্ন হইয়া নলডাঙ্গা, নড়াইল, নাটোর, দীঘাপতিয়া প্রভৃতির জমিদারী গঠন করিল । মুর্শিদাবাদে সীতারামের নৃশংস প্রাণদণ্ডের বিবরণ সলিমুল্লার তারিখ-ই-বংগালাতে এবং পরে ষ্টুয়ার্টের ইতিহাসে পাওয়া যায় । তাঁহার পরাজয়ের তারিখ ফেব্রুয়ারি ১৭১৪, এবং মৃত্যুর সময় বোধ হয় সেই বৎসরের অক্টোবর মাস (সতীশ, ২য় খণ্ড, ৫৮৯-৬০০ পৃ )। তখনকার দেশের দশা তেইশ বৎসর কাল মহা প্রতাপে বঙ্গদেশ শাসন করিয়া নবাব শায়েস্তা খাঁ ১৬৮ খ্রীষ্টাব্দের বর্ষাশেষে পদত্যাগ করিয়া আগ্রায় ফিরিয়া গেলেন। তাঁহার ক্ষমতায় দেশময় শাস্তি, ধনবৃদ্ধি, রাজ্যবৃদ্ধি ও সভ্যতার বিকাশ হইতেছিল । পরবৎসরের মাঝামাঝি নূতন সুবাদার হইয়া আসিলেন ইব্রাহিম খাঁ ; ইনি পরম ধার্মিক, বৃদ্ধ, সর্বদা বই পড়িতে ও পণ্ডিতদের সঙ্গে আলোচনা করিতে ভাল বাসিতেন; যুদ্ধবিগ্রহ বা চারি দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা তাঁহার প্রকৃতির বিরোধী। অথচ ইনি বড় ন্যায়পরায়ণ, কোমলহৃদয় শাসক ছিলেন। ইংরাজ বণিকেরা তাঁহাকে "the most famously just good nabob” বলিয়া প্রশংসা করিয়াছেন। পারসিক ইতিহাসে লিখিত আছে যে, তিনি একটি পিঁপড়ার প্রতিও অত্যাচার হইতে দিতেন না। তাঁহার চেষ্টায় বাঙ্গলার চাষ-বাস ও বাণিজ্য বেশ বাড়িতে থাকিল। কিন্তু বাহির হইতে এক রাজনৈতিক ঝড় আসিয়া তাঁহার গুণগুলিকে দোষে পরিণত করিল, বাঙ্গলায় অরাজকতা আনিয়া দিল । ঠিক এই ১৬৮৯ খ্রীষ্টাব্দের প্রথমেই বাদশাহ আওরংজীবের গৌরব ও সৌভাগ্য চরমে উঠিয়াছিল ; তিনি ইহার পূর্বের তিন বৎসরে দাক্ষিণাত্যের শেষ তিনটি স্বাধীন রাজ্য ধ্বংস করেন—বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার সুলতান দুই জনকে বন্দী করিয়া এবং মারাঠারাজ শম্ভুজীকে হত্যা করিয়া ; মুঘল সাম্রাজ্য নামতঃ আহিমাচল-কুমারিকা পর্য্যন্ত বিস্তৃত হইল। কিন্তু ঠিক ইহার পরেই তাঁহার পতন আরম্ভ হইল । দক্ষিণে মারাঠারা, উত্তরে জাঠ ও রাজপুতেরা ক্ষেপিয়া উঠিল, শাসন ছত্রভঙ্গ হইল, সাম্রাজ্য জুড়িয়া বিপ্লব ও অরাজকতা ছড়াইয়া পড়িল। মারাঠা জনসঙ্ঘ সাম্রাজ্যতন্ত্রকে বিধ্বস্ত করিয়া দিল, তাহাদের হাতে কত বড় বড় মুঘল