পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১০০

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
খোঁড়া সুধীর

 গ্রামের স্কুল ছাড়িয়া আমি প্রথম যে শহরের স্কুলে আসিয়া ভর্তি হইলাম, সেখানে আমার মাসতুতো ভাই খগেন্দ্রও থাকিত। সে আমার তিন বৎসর আগে এখানে আসিয়াছে। খগেন্দ্র আর আমি এক ক্লাশে পড়ি, বোর্ডিংয়েও এক ঘরেই থাকি।

 আমাদের পাশের ঘরে নরেন ও সুধীর বলিয়া দুইটি ছেলে থাকে। তাহাদের দুইজনে দেখি খুব ভাব, তেমন ভাব আর কোনো ছেলেদের মধ্যে দেখি নাই। অথচ তাহাদের চেহারা যেমন উলটা, স্বভাবও তেমনি ভিন্ন রকমের। নরেনের রঙ ময়লা, দেখিতে লম্বা চওড়া, বেজায় ষণ্ডা, খুব হৈ চৈ করিয়া বেড়ায়; সুধীর ফর্সা রোগা ছোটোখাটো দেখিতে, আর খোঁড়া; সব সময়ে চুপচাপ থাকে।

 একদিন আমি স্কুলের পর বোর্ডিংয়ের দিকে যাইতেছিলাম। হঠাৎ সামনে চাহিয়া দেখি বেচারা সুধীর খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া যাইতেছে, আর তাহার পিছু পিছু একটা ছেলে তাহাকে ভ্যাঙ্‌চাইয়া খোঁড়াইয়া চলিতেছে। নরেন যে পিছনে আসিতেছে তাহা সে দেখিতে পায় নাই। শুধু ভ্যাঙ্‌চাইয়া তাহার মন উঠিল না। সে বলিতে লাগিল, “খোড়া ন্যাং ন্যাং ন্যাং, কার বাড়িতে—” তাহার মুখের কথা শেষ হইতে না হইতে নরেন আসিয়া বাঘের মতো তাহার উপরে পড়িল, আর দুই কাঁধে দুই হাত দিয়া এমন ঝাঁকড়ানি দিল যে ছেলেটা প্রাণ লইয়া পলাইতে পারিলে বাঁচে।

 সেদিন রাত্রে শুইবার সময় আমি খগেন্দ্রের কাছে এই গল্প করিলাম। খগেন্দ্র বলিল, “আমি থাকলে আমিও দু-চার ঘা দিতাম।” আমি বলিলাম, “সুধীর খোঁড়া বলেই বোধ হয় তার উপরে নরেনের এত মায়া।” খগেন্দ্র বলিয়া উঠিল, “ওঃ, তা বুঝি জানিস না। এখন ওদের এত ভাব দেখছিস, কিন্তু এমন সময় ছিল যখন নরেন সুধীরকে দুচক্ষে দেখতে পারত না।” আমি আশ্চর্য হইয়া বলিলাম, “সত্যি” “তা না তো কি?” বলিয়া খগেন্দ্র লেপটা ভালো করিয়া টানিয়া গায়ে দিয়া বলিতে লাগিল— “সুধীর যখন নূতন এল তখন তার ছোটোখাটো ভালোমানুষের মতো চেহারা দেখে কেউ

ইস্কুলের গল্প
১৭
সু. স. র.—২-১২