পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১০১

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

তাকে বড়ো-একটা গ্রাহ্য করে নি। কিন্তু ক্রমে দেখা গেল যে পড়াশোনায় সে খুব ভালো। আগে নরেন ক্লাশে সবচেয়ে ভালো ছিল, সুধীর এলে সুধীরই ফার্স্ট হতে লাগল। তাতে নরেন তার ওপর ভারি চটে গেল। দেখতে দেখতে ক্লাশে দুটো দল হয়ে উঠল। নরেন বড়োলোকের ছেলে, খেলাধুলায় সকলের সর্দার, তার অনেক চেলা। হ্যাঁ, আসল কথাটাই বলতে ভুলে গেছি, সুধীর কিন্তু তখন খোঁড়া ছিল না। তার কোঁকড়ানো চুল, বড়ো-বড়ো চোখ আর সুন্দর মুখখানা দেখে, নরেন তার নাম রাখল খোকাবাবু—সেই নাম স্কুলময় প্রচার হয়ে গেল। একদিন সুধীরের বাড়ি থেকে কি চিঠি এল তাই পড়ে সুধীর কেঁদেছিল। সেদিন রাত্রে পড়বার সময় টেবিলের এককোণে একজন বলল, ‘বেবি’ (baby), আর একজন জোরে বলল, ‘মাস্টারমশাই বেবি মানে কি খোকা?’ একজন জোরে জোরে বলতে লাগল, ‘c-r-y ক্রাই—ক্রাই মানে কান্না।’ সুধীর বেচারা চুপ করে বসে রইল।

 “একবার হল কি, এই গত বছর পূজার ছুটির পরে, প্রাইজের দুমাস আগে বলে দেওয়া হল যে, ‘এবার ইংরাজি রচনার জন্য একটা আলাদা প্রাইজ দেওয়া হবে।’ নরেনের দলের ছেলেরা বলল, ‘নরেন প্রাইজ পাবে,’ অন্য ছেলেরা বলল, ‘সুধীর পাবে।’ খুব একটা রেষারেষি চলল।

 “তখন সুধীর আমাদের এই পাশের ঘরটাতেই থাকত। প্রাইজের রচনা দেবার আর একদিন মাত্র বাকি আছে—সুধীরের রচনা প্রায় লেখা হয়ে গেছে, নরেনেরও হয়েছে। রাত্রে সুধীর সেটাকে ভালো করে তুলবে বলে দেরাজ খুলে দেখে রচনার খাতা নেই। কত খুঁজল কোথাও পেল না। সে মনে করল বোধ হয় ভুলে বইয়ের সঙ্গে স্কুলে নিয়ে গিয়েছে, কোথায় পড়ে গেছে। লণ্ঠন নিয়ে কত খুঁজল কিন্তু কোথাও পেল না। তখন তার ঘরে রাজেন বলে একটি ছেলে থাকত সে বলল, ‘আমি বলছি এ নিশ্চয় নরেনের কাজ। কাল সন্ধ্যার সময় আমি একবার পড়তে পড়তে উঠে এসেছিলাম। তখন বোধ হল নরেন আমাদের ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এ নিশ্চয় ওর কাজ।’ সুধীর বলল, ‘ছি। অমন বলতে নেই। আমরা তো ঠিক জানি না।’

 “সুধীর আর কি করবে, তখন তাড়াতাড়ি করে আরেকটা রচনা লিখে দিল বটে, কিন্তু বেচারার ভালো করে লেখাই হল না। নরেনই প্রাইজ পেল। প্রায় মাসখানেক পরে একদিন সুধীর আর রাজেন নরেনের ঘরের নীচে উঠোন দিয়ে যাচ্ছিল, এমন সময় কতগুলো ছেঁড়া কাগজ ঝুর্‌ঝুর্‌ করে তাদের মাথার ওপরে পড়ল। রাজেন রেগে মাথা ঝাড়তে ঝাড়তে উপরের দিকে চেয়ে নরেনের হাতটা দেখতে পেল। তারা চলেই যাচ্ছিল, হঠাৎ এক টুকরো লেখা কাগজের উপর তাদের চোখ পড়ল। সেটা সুধীরের সেই হারানো খাতার পাতার টুকরো। রাজেন বলল, ‘আমি এক্ষুনি যাচ্ছি, মাস্টারদের এটা দেখাব।’ সুধীর তাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘এ নিয়ে আর গোলমাল করে কি হবে?’

 “সেদিন ছুটির পর রাজেন নরেনকে পাকড়াও করল। নরেন তখন দোতলায় ঐ কাঠের সিঁড়িটার কাছে দাড়িয়েছিল। রাজেন গিয়ে বলল, ‘তুমি সুধীরের রচনার খাতা চুরি করেছিলে! এই দেখ তার প্রমাণ। তা ছাড়া সেদিন রাত্রে আমি তোমাকে আমাদের

৯৮
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী: ২