পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বলিয়া এমন চেঁচাইয়া উঠিল যে পণ্ডিতমহাশয়ের চোখ হইতে হঠাৎ চশমাটা পড়িয়া গেল। মাস্টারমহাশয় গম্ভীরভাবে ঘরের মধ্যে ঢুকিলেন, তার পর কেন জানি না, হরিপ্রসন্নর কানে ধরিয়া তাহাকে সমস্ত স্কুল ঘুরাইয়া আনিলেন, তাহাকে তিনদিন ক্লাশে দাঁড়াইয়া থাকিতে হুকুম দিলেন, একটাকা জরিমানা করিলেন, তাহার কালো কোটের পিঠে খড়ি দিয়া ‘বাদর’ লিখিয়া দিলেন, আর স্কুল হইতে তাড়াইয়া দিবেন বলিয়া শাসাইয়া রাখিলেন।

 পরের দিন রামবাবু হরিপ্রসন্নকে ডাকিয়া পাঠাইলেন এবং তাহার কাছে সমস্ত কথা শুনিয়া আমাদের ক্লাশে খোঁজ করিতে আসিলেন। তখন ফকিরচাঁদ বলিল, “আজ্ঞে হরে চেঁচায় নি—আমি চেঁচিয়েছি।” রামবাবু বলিলেন, “পণ্ডিতমহাশয়কে ‘পাতকী’ বলিয়া কি গালাগালি করিয়াছিলে?” ফকির বলিল, “পণ্ডিতমশাইকে কিছুই বলি নি, আমি পড়ছিলাম—

 “‘অন্ধকারে চৌরাশিটা নরকের কুণ্ড, তাহাতে ডুবায়ে ধরে পাতকীর মুণ্ড’।” এই সময়ে নূতন পণ্ডিতমহাশয় ক্লাশের পাশ দিয়া যাইতেছিলেন। তিনি বোধ হয় শেষ কথাটুকু শুনিতে পাইয়াছিলেন এবং ভাবিয়াছিলেন তাঁহাকে লইয়া কিছু ঠাট্টা করা হইতেছে। তিনি রাগে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারাইয়া হাঁ-হাঁ করিয়া ক্লাশের মধ্যে আসিয়া রামবাবুর কালো কোট দেখিয়াই “তবে রে হরিপ্রসন্ন” বলিয়া হেডমাস্টার মহাশয়কে পিটাইতে লাগিলেন। আমরা ভয়ে কাঠ হইয়া রহিলাম। হেডমাস্টার মহাশয় অনেক কষ্টে পণ্ডিতের হাত ছাড়াইয়া তাঁহার দিকে ফিরিয়া দাঁড়াইলেন।

 তখন যদি পণ্ডিতের মুখ দেখিতে! বেচারা ভয়ে একেবারে জুজু—তিন-চারবার হাঁ করিয়া আবার মুখ বুজিলেন, তার পর এদিক-ওদিক চাহিয়া এক দৌড়ে সেই যে স্কুল হইতে পলাইয়া গেলেন, আর কোনোদিন তাঁহাকে স্কুলে আসিতে দেখি নাই।

 দুইদিন পরে পুরাতন পণ্ডিতমহাশয় আবার ফিরিয়া আসিলেন। তাঁহার মুখ দেখিয়া আমাদের যেন ধড়ে প্রাণ আসিল—আমরা হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলাম। সকলে প্রতিজ্ঞা করিলাম, আর পণ্ডিতমহাশয়ের ক্লাশে গোলমাল করিব না। যতই পড়া দিন-না কেন, খুব ভালো করিয়া পড়িব।

সন্দেশ-আষাঢ়, ১৩২৩


জগ্যিদাসের মামা

 তার আসল নামটি যজ্ঞদাস। সে প্রথম যেদিন আমাদের ক্লাশে এসেছিল পণ্ডিতমশাই তার নাম শুনেই এক ধমক দিলেন, “যজ্ঞের আবার দাস কি? যজ্ঞেশ্বর বললে তবু নাহয় বুঝি।” ছেলেটি বলল, “আজ্ঞে, আমি তো নাম রাখি নি, নাম রেখেছেন খুড়োমশাই।”

 এই শুনে আমরা হো হো করে হেসে উঠতেই পণ্ডিতমশাই হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বানান কর যজ্ঞদাস।” আমি থতমত খেয়ে বললাম, “বর্গীয় জ”—পণ্ডিতমশাই বললেন, “দাড়িয়ে থাক।” তার পর একটা ছেলে ঠিক বানান বললে পর তিনি আরেক-

১০৪
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী:২