পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কিন্তু কয়দিন পরেই শ্যামচাঁদ ইহার শোধ লইয়া ফেলিল। সেদিন সে ক্লাশে আসিয়াই পকেট হইতে কালো চোঙার মতো কি একটা বাহির করিল। মাস্টারমহাশয় সাদাসিধা ভালোমানুষ, তিনি বলিলেন, “কি হে খোকা, থার্‌মোমিটার এনেছ যে। জ্বরটর হয় নাকি?” শ্যামাদ বলিল, “আজ্ঞে না থার্‌মোমিটার নয়-ফাউনটেন পেন।” শুনিয়া সকলের তো চক্ষুস্থির। ফাউনটেন পেন। মাস্টার এবং ছেলে সকলেই উদগ্রীব হইয়া দেখিতে আসিলেন, ব্যাপারখানা কি! শ্যামচাঁদ বলিল, “এই একটা ভাল্‌কেনাইট টিউব, তার মধ্যে কালি ভরা আছে। একটা ছেলে উৎসাহে বলিয়া উঠিল, “ও, বুঝেছি, পিচকিরি বুঝি? এইখানে টিপে দিলেই ছরর‌্‌র‌্‌‌ করে কালি বেরুবে?” শ্যামচাঁদ কিছু জবাব না দিয়া খুব মাতব্বরের মতো একটুখানি মুচকি হাসিয়া কলমটিকে খুলিয়া তাহার সোনালি নিবখানা দেখাইয়া বলিল, “ওতে ইরিডিয়ম আছে—সোনার চেয়েও বেশি দাম।” তার পর যখন সে একখানা খাতা লইয়া সেই আশ্চর্য কলম দিয়া তর্‌তর্ করিয়া নিজের নাম লিখিতে লাগিল, তখন স্বয়ং মাস্টারমহাশয় পর্যন্ত বড়ো-বড়ো চোখ করিয়া দেখিতে লাগিলেন। তার পর শ্যামচাঁদ কলমটিকে তাঁর হাতে দিবামাত্র তিনি ভারি খুশি হইয়া সেটাকে নাড়িয়া চাড়িয়া দুইছত্র লিখিয়া বলিলেন, “কি কলই বানিয়েছে—বিলিতি কোম্পানি বুঝি?” শ্যামচাঁদ চটপট বলিয়া ফেলিল, “আমেরিকান স্টাইলো এণ্ড ফাউনটেন পেন কোং ফিলাডেল্‌ফিয়া।” সেইদিন হইতে ক্লাশে তাহার ‘খোকা’ নাম ঘুচিল—কিন্তু আমরা আরো বেশি করিয়া বলিতাম, “চালিয়াৎ!”

 যাহা হউক চালিয়াতের চালচলনের আলোচনা চলিতে চলিতে পূজার ছুটি আসিয়া পড়িল। ছুটির দিন স্কুলের উঠানে প্রকাণ্ড শামিয়ানা খাটানো হইল, কলিকাতা হইতে কে-এক বাজিওয়ালা আসিয়াছেন, তিনি 'ম্যাজিক' দেখাইবেন। যথাসময়ে সকলে আসিলেন, মাষ্টার ছাত্র, লোকজন, নিমন্ত্রিত-অভ্যাগত সকলে মিলিয়া উঠান, সিঁড়ি, রেলিং, পাঁচিল একেবারে ভরিয়া ফেলিয়াছে। ম্যাজিক চলিতে লাগিল। একখানা সাদা রুমাল চোখের সামনেই লাল নীল সবুজের কারিকুরিতে রঙিন হইয়া উঠিল। একজন লোক একটা সিদ্ধ ডিম গিলিয়া মুখের মধ্য হইতে এগারোটা আস্ত ডিম বাহির করিল! ডেপুটিবাবুর কোচম্যানের দাড়ি নিংড়াইয়া প্রায় পঞ্চাশটি টাকা বাহির করা হইল। তার পর ম্যাজিকওয়ালা জিজ্ঞাসা করিল, “কারও কাছে ঘড়ি আছে?” শ্যামচাঁদ তাড়াতাড়ি ব্যস্ত হইয়া বলিল, “আমার ঘড়ি আছে।” ম্যাজিকওয়ালা তাহার ঘড়িটি লইয়া খুব গম্ভীরভাবে নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিল। ঘড়িটির খুব প্রশংসা করিয়া বলিল, “তোফা ঘড়ি তো।” তার পর চেনসুদ্ধ ঘড়িটাকে একটা কাগজে মুড়িয়া একটা হামানদিস্তায় দমাদম্ ঠুকিতে লাগিল। তার পর কয়েক টুকরা ভাঙা লোহা আর কাচ দেখাইয়া শ্যামচাঁদকে বলিল, “এইটা কি তোমার ঘড়ি?” শ্যামচাঁদের অবস্থা বুঝিতেই পার। সে হাঁ করিয়া তাকাইয়া রহিল, দু-তিনবার কি যেন বলিতে গিয়া আবার থামিয়া গেল। শেষটায় অনেক কষ্টে একটু কাষ্ঠহাসি হাসিয়া রুমাল দিয়া ঘাম মুছিতে মুছিতে বসিয়া পড়িল। যাহা হউক, খানিক বাদে যখন একখানা পাউরুটির মধ্যে ঘড়িটাকে আস্ত অবস্থায় পাওয়া গেল, তখন ‘চালিয়াৎ' খুৰ হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল—যেন তামাশাটা সে আগাগোড়াই বুঝিতে পারিয়াছে।

১১৪
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২