পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বলিল, “এটা বুঝি কিছু নয়?” এবার শ্যামচাঁদ একেবারে ভ্যাঁ করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। তাহার পর পাগলের মতো হাত-পা ছুঁড়িয়া-সভা হইতে ছুটিয়া বাহির হইল। আমরা সবাই আহ্লাদে আত্মহারা হইয়া চেঁচাইতে লাগিলাম—'চালিয়াৎ! চালিয়াৎ!'

সন্দেশ জ্যৈষ্ঠ, ১৩২৪


পালোয়ান


 তাহার আসল নামটি যে কি ছিল, তাহা ভুলিয়াই গিয়াছি—কারণ আমরা সকলেই তাহাকে 'পালোয়ান' বলিয়া ডাকিতাম। এমন-কি, মাস্টারমহাশয়রা পর্যন্ত তাহাকে ‘পালোয়ান’ বলিতেন। কবে কেমন করিয়া তাহার এরূপ নামকরণ হইল, তাহা মনে নাই। কিন্তু নামটি যে তাহাকে বেশ মানাইয়াছিল, এ কথা স্কুলসুদ্ধ সকলেই একবাক্যে স্বীকার করিত।

 প্রথমত, তাহার চেহারাটি ছিল একটু অতিরিক্ত রকমের হৃষ্টপুষ্ট। মোটাসোটা হাত-পা, ব্যাঙের মতো গোব্‌দা গলা—তাহার উপরেই গোলার মতো মাথাটি—যেন ঘাড়ে পিঠে এক হইয়া গিয়াছে। তার উপর সে কলিকাতায় গিয়া স্বচক্ষে কাল্লু ও করিমের লড়াই দেখিয়া আসিয়াছিল, এবং বড়ো-বড়ো কুস্তির এমন আশ্চর্যরকম বর্ণনা দিতে পারিত যে শুনিতে শুনতে আমাদেরই রক্ত গরম হইয়া উঠিত। এক-একদিন উৎসাহের চোটে আমরাও তাল ঠুকিয়া স্কুলের উঠানে কুস্তি বাধাইয়া দিতাম। পালোয়ন তখন পাশে দাঁড়াইয়া নানারকম অঙ্গভঙ্গি করিয়া আমাদের প্যাঁচ ও কায়দা বাতলাইয়া দিত। মাখনলাল আমার চাইতে আড়াই বছরের ছোটো, কিন্তু পালোয়ানের কাছে ‘ল্যাংমুচ্‌কির’ প্যাঁচ শিখিয়া সে যেদিন আমায় চিৎপাত করিয়া ফেলিল, সেইদিন হইতে সকলেরই এই বিশ্বাস পাকা হইল যে, পালোয়ান ছোকরাটা আর কিছু না বুঝুক কুস্তিটা বেশ বোঝে।

 ঘোষেদের পাঠশালার ছাত্রগুলা বেজায় ডানপিটে। খামখা এক-একদিন আমাদের সঙ্গে গায়ে পড়িয়া তাহারা ঝগড়া বাধাইত। মনে আছে, একদিন ছুটির পরে আমি আর পাঁচ-সাতটি ছেলের সঙ্গে গোঁসাইবাড়ির পাশ দিয়া আসিতেছিলাম, এমন সময় দেখি পাঠশালার চারটা ছোকরা তেল মারিয়া আম পাড়িতেছে। একটা ঢিল আরেকটু হইলেই আমার গায়ে পড়িত। আমরা দলে ভারি ছিলাম, সেই সাহসে আমাদের একজন ধমক দিয়া উঠিল, “এইও, বেয়াদব! মানুষ চোখে দেখিস নে?” ছোছকরাদের এমনি আস্পর্ধা, একজন অমনি বলিয়া উঠিল, “হাঁ, মানুষ দেখি, বাঁদরও দেখি।” শুনিয়া সব কটায় অসভ্যের মতো হো হো করিয়া হাসিতে লাগিল। আমার তখন ভয়ানক রাগ হইল, আমি অস্তিন গুটাইয়া বলিলাম, “পরেশ! দে তো আচ্ছা করে ঘা দুচ্চার কষিয়ে।” পরেশও দমবার পাত্র নয়, সে হুংকার দিয়া বলিল, “গুপে, আন তো ঐ ছোকরাটার কানে ধরে।” গোপীকেষ্ট বলিল,—“আমার হাতে বই আছে-ওরে ভুতো, তুই ধর

১০৮
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২