তখন আমরা সকলে মিলিয়া দুজনকে ছাড়াইয়া দিলাম। পালোয়ান হাঁপাইতে হাঁপাইতে বেঞ্চে বসিয়া ঘাম মুছিতে লাগিল। তার পর গম্ভীরভাবে বলিল, “ছেলেবেলায় এই ডানহাতের কব্জিটা জখম হয়েছিল-তাই বড়ো-বড়ো প্যাঁচগুলো দিতে ভরসা হয় না-কি জানি হাতটা যদি আবার মচ্কে ফচ্কে যায়। তা নইলে ওকে একবার দেখে নিতুম।” ভুতো এ কথার কোনো উত্তর না দিয়া, তাহার নাকের সামনে একবার বেশ করিয়া 'কাঁচকলা’ দেখাইয়া লইল।
ভুতো ছেলেটি দেখিতে যেমন রোগা এবং বেঁটে, তার হাত-পাগুলিও তেমনি লট্খটে, সুতরাং পালোয়নের পালোয়ানি সম্বন্ধে অনেকের যে আশ্চর্য ধারণা ছিল, সেইদিনই তাহা ঘুচিয়া গেল। কিন্তু পালোয়ান নামটি আর কিছুতেই ঘুচিল না। সেটি শেষপর্যন্ত টিকিয়া ছিল।
আমাদের 'সবজান্তা' দুলিরামের বাবা কোন একটা খবরের কাগজের সম্পাদক। সেইজন্য আমাদের মধ্যে অনেকেরই মনে তাহার সমস্ত কথার উপরে অগাধ বিশ্বাস দেখা যাইত। যে কোনো বিষয়েই হোক, জার্মানির লড়ায়ের কথাই হোক আর মোহনবাগানের ফুটবলের ব্যাখ্যাই হোক, দেশের বড়োলোকদের ঘরোয়া গল্পই হোক আর নানারকমের উৎকট রোগের বর্ণনাই হোক, যে কোনো বিষয়ে সে মতামত প্রকাশ করিত, একদল ছাত্র অসাধারণ শ্রদ্ধার সঙ্গে সে-সকল কথা শুনিত। মাস্টারমহাশয়দের মধ্যেও কেহ কেহ এ বিষয়ে তাহার ভারি পক্ষপাতী ছিলেন। দুনিয়ার সকল খবর লইয়া সে কারবার করে, সেইজন্য পণ্ডিতমহাশয় তাহার নাম দিয়াছিলেন ‘সবজান্তা'।
আমার কিন্তু বরাবরই বিশ্বাস ছিল যে, সবজান্তা যতখানি পাণ্ডিত্য দেখায় আসলে তার অনেকখানিই উপরচালাকি। দু-চারিটি বড়ো-বড়ো শোনা-কথা, আর খবরের কাগজ পড়িয়া দু-দশটা খবর, এইমাত্র তার পুঁজি, তাহারই উপর রঙচঙ দিয়া নানারকম বাজে গল্প জুড়িয়া সে তাহার বিদ্যা জাহির করিত। একদিন আমাদের ক্লাশে পণ্ডিতমহাশয়ের কাছে সে নায়েগারা জলপ্রপাতের গল্প করিয়াছিল। তাহাতে সে বলে যে নায়েগারা দশ মাইল উঁচু ও একশত মাইল চওড়া! একজন ছাত্র বলিল, “সে কি করে হবে? এভারেস্ট সবচেয়ে উঁচু পাহাড়, সেই মোটে পাঁচ মাইল—” সবজান্তা তাহাকে বাধা দিয়া বলিল, “তোমরা তো আজকালকার খবর রাখ না!” যখনই তাহার কোনো কথায় আমরা সন্দেহ বা আপত্তি করিতাম সে একটা যা-তা নাম করিয়া আমাদের ধমক দিয়া বলিত, “তোমরা কি অমুকের চাইতে বেশি, জান?” আমরা বাহিরে সব সহ্য করিয়া থাকিতাম, কিন্তু এক-এক সময় রাগে গা জ্বলিয়া যাইত।
সবজান্তা যে আমাদের মনের ভাবটা বুঝিত না, তাহা নয়। সে তাহা বিলক্ষণ